ঘাটালের দাসপুরে প্রচারে মানস ভুঁইয়া।—নিজস্ব চিত্র।
ট্রাই নেক্সট টাইম, ডঃ ভুঁইয়া!
এক বার আলো নিভছে। এক বার আগুন লাগছে গণনা কেন্দ্রে। দমকলের গাড়ি ঢুকে হু হু জলের তোড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে কাউন্টিং টেবল! টানা আট ঘণ্টার নাটকীয় গণণা শেষে বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী মাখনলাল বাঙাল ৮২৫ ভোটে জয়ী ঘোষিত হলেন। বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে গণনা বাতিলের আর্জি জানাতে তৎকালীন জেলাশাসক হেমচন্দ্র পাণ্ডের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পরাজিত প্রার্থী মানস ভুঁইয়া। আর্জির জবাবে জেলাশাসকের মন্তব্য ছিল, পরের বার চেষ্টা করবেন আবার!
সবং বিধানসভা কেন্দ্রে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ঘটনা। মাঝের ১৮ বছরে রাজ্যে সরকার বদলে গিয়েছে। সে দিনের প্রশাসনিক কর্তারা অনেকেই অবসর নিয়েছেন, কেউ কেউ দেশের অন্য প্রান্তে কর্মরত। মানসবাবু আজও আছেন সেই সবংয়েই, কংগ্রেসের বিধায়ক হয়ে। আঠারোটি বসন্ত পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর একটি মন্তব্য তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে পুুরনো সেই স্মৃতিতে! জেলাশাসকের সেই মন্তব্যে আশাহত হয়ে লড়াই ছেড়ে দেননি যে মানসবাবু। ঘটিবাটি বেচে দেওয়ার উপক্রম হলেও তিন বছর মামলা লড়ে আদালতে প্রমাণ করিয়ে আনতে পেরেছিলেন, তাঁকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই মানসবাবু রিগিং করে ঘাটাল লোকসভা আসনে জেতার চেষ্টা করবেন, সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অভিযোগ শোনার পর থেকে বারবার পুরনো ঘটনাগুলো ভেসে উঠছে সবংয়ের চিকিৎসক বিধায়কের স্মৃতিতে!
বাম জমানায় স্বয়ং মমতা এবং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সোমেন মিত্র, সৌগত রায়-সহ কংগ্রেস এবং তৃণমূলের তাবড় নেতা-নেত্রীরা সিপিএমের বিরুদ্ধে রিগিংয়ের ভূরি ভূরি অভিযোগ করেছেন। কোনও অভিযোগই কখনও প্রমাণ হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম মানসবাবু। সে বার ভোটের পরে কয়েকটি ব্যালটবাক্স খড়গপুরে স্ট্রং রুমে নিয়ে যাওয়ার পথেই লুঠ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল মানসবাবুর। পুলিশ কোনও সহযোগিতাই করেনি। প্রয়াত নেতা তথা আইনজীবী অজিত পাঁজা, আর কে লালা এবং সবংয়ের জয়ন্ত দাস এই তিন জনকে কৌঁসুলি করে মামলা লড়েছিলেন মানসবাবু। প্রতি শুনানিতে আদালতে গিয়ে বসে থাকতেন স্ত্রী গীতা ভুঁইয়া। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি শ্যামল সেনরায় দিয়েছিলেন, সবংয়ে ব্যালট পেপার ‘স্মাগ্ল’ করা হয়েছিল! হিসাব করে দেখা গিয়েছিল, মোট যত ভোট পড়েছিল, ব্যালট গোনা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। ওই কেন্দ্রের নির্বাচনকেই খারিজ করে দিয়েছিল আদালত।
রিগিং প্রমাণে সফল রাজ্য রাজনীতির একমাত্র কুশীলব সেই মানসবাবু এখন বলছেন, “আমি পরিযায়ী পাখি নই। রাজনৈতিক উদ্বাস্তুও নই! বাক্স ভেঙে আমাকে হারিয়ে দিয়েছিল সিপিএম! আমি রিগিং করতে যাব?”
মানসবাবুকে জড়িয়ে অভিযোগ কেন করতে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী? ঘটনা হল, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বাকি দুই কেন্দ্র ঝাড়গ্রাম ও মেদিনীপুরে ভোট ৭ মে। আর মানসবাবু যেখানে কংগ্রেস প্রার্থী, সেই ঘাটালে ভোট ১২ মে। এই সূত্রেই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল, “ঘাটালে দেবের (তৃণমূলের তারকা-প্রার্থী) কাছে মানস ভুঁইয়া হেরে ভূত হবে! হেরো! তাকে রিগ করতে দিতে হবে। তাই আলাদা ভোট!” যদিও প্রশাসন সূত্রের বক্তব্য, বাকি দুই কেন্দ্র জঙ্গলমহলের মধ্যে বলে আলাদা ব্যবস্থা। এর সঙ্গে মানসবাবু বা কোনও প্রার্থীরই কোনও সম্পর্ক নেই।
কংগ্রেস প্রার্থী তাই বলছেন, “মাথা ঠান্ডা করে একটু ভাবুন মুখ্যমন্ত্রী! যে দিন আদালতে জিতেছিলাম, একটা বিবৃতিও দেননি। আর এখন আমার বিরুদ্ধে রিগিং-এর আশঙ্কা করছেন!” ঘাটাল কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ছে কেশপুর। বাম জমানায় যে কেশপুর লাল সন্ত্রাসের জন্য কুখ্যাত ছিল, সেখানেই এখন তৃণমূলের কাজিয়া সামলাতে চার বার ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে! মানসবাবু বলছেন, “কেশপুরে যাতে গণতন্ত্র ফেরে, মানুষ যাতে নির্ভয়ে ভোট দেন, তার জন্য লড়াই করছি। হারা-জেতা গণতন্ত্রে থাকবেই।”
তৃণমূলের মতোই ঘাটালে মানসবাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআই-ও। সেই দলের এক রাজ্য নেতাও বলছেন, “মানসবাবুর সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধ। তবে তিনি রিগিং করবেন, এটা বলা বাড়াবাড়ি!” আর খোদ মানসবাবু খোঁচা দিচ্ছেন, “আমি সবংয়ে ২০০১ সালে হেরেছিলাম। কিন্তু সবং ছেড়ে যাইনি। উনি (তৃণমূল নেত্রী) তো যাদবপুরে হেরে দক্ষিণ কলকাতায় সরে গিয়েছিলেন!”
আঠারো বছর আগে মামলা যখন সুপ্রিম কোর্টে টেনে নিয়ে যাওয়া হল, বঙ্গভবনে খাবারের বিল মেটানোও তখন দায় মানসবাবুর। অসহায় বিচারপ্রার্থী সে দিনের অন্তঃপুরবাসিনী সনিয়া গাঁধীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। প্রিয় ‘মানস’কে ১ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন রাজীব-জায়া। অর্থ সাহায্য করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আর কলকাতায় মামলা শেষে অজিতবাবুর কাছে টাকা নিয়ে গিয়ে জুটেছিল সস্নেহ থাপ্পড়! “তুই কি পাগল হয়েছিস মানস?”
সবংয়ের মানস আজও পাগল! অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে জেনেও পিছোবেন না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy