হিমঘরের পথে। বুধবার পান্ডুয়ায়। —নিজস্ব চিত্র।
ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানো আটকাতে গত বারও আইনি এক্তিয়ার টপকে সীমানা কার্যত ‘সিল’ করে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। এ বার একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, অন্য রাজ্যে আলু রফতানিতে আর বাধা নেই। বরং ভিন্ রাজ্য এবং বিদেশে আলু পাঠালে আর্থিক সাহায্য করা হবে। সহায়ক মূল্যে চাষিদের থেকে সরাসরি আলু কেনাও শুরু করবে রাজ্য সরকার।
রাজ্যে আলুর ব্যাপক ফলন হওয়ায় খোলা বাজারে ইতিমধ্যেই দাম পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন চাষিরা। বুধবারও হাওড়া, হুগলি এবং বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গায় গোলমাল হয়। বর্ধমানের কালনায় রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ দেখান চাষিরা। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বুঝেই এ দিন সরাসরি চাষিদের থেকে আলু কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও রাজ্যে সহায়ক মূল্যে চাষিদের থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রক্রিয়াই এখনও গতি পায়নি। অভাবী বিক্রি চলছেই।
এ দিন নবান্নে আলু কেনা ও রফতানি সম্পর্কিত ওই দু’টি ঘোষণা করলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু জানাননি, কবে থেকে কী দামে চাষিদের কাছ থেকে আলু কেনা শুরু হবে। কেন সরকারের এই বোধোদয়, তারও ব্যাখ্যা মেলেনি। চাষিদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসতেই সতর্ক হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। রাজ্যের বহু মানুষ আলুচাষ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁরা মার খেলে ভোটযন্ত্রে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। তাই এই ভোলবদল। সিপিএম প্রভাবিত কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বর্ধমান জেলা সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডলের কটাক্ষ, “ভোট এগিয়ে আসতেই মুখ্যমন্ত্রীর বুদ্ধি খুলে গিয়েছে। তাই ঘর সামলানোর চেষ্টা করছেন।”
রাজ্য সরকারের মতে, রাজ্যে এ বছর এক কোটি ২০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যা প্রায় রেকর্ড ফলন। গত মরশুমে যেখানে ফলন হয়েছিল ৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন। এ বার রাজ্যে আলুচাষের জমিও ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে। অন্য দিকে, প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও ভাল ফলন হওয়ায় আলুর চাহিদা কম। ফলে দূরের রাজ্য বা বিদেশে আলু পাঠাতে না পারলে ক্ষতি সামাল দেওয়া কঠিন।
বহু জেলায় দাম না পাওয়ায় চাষিরা মাঠ থেকে আলু না তুলে জমিতেই রেখে দিয়েছেন। তাঁদের আক্ষেপ, বাজারে যে দাম মিলছে তাতে খরচের অর্ধেকও উঠছে না। বর্ধমানের বেলকাশ এলাকার শেখ লালটু বলেন, “১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ কিলো আলুর বস্তা। তাতেও খদ্দের নেই। আলু হিমঘরে ভরতে গিয়েই অন্তত ২০০ টাকা খরচ পড়ে যাচ্ছে।”
এ দিন নবান্নে কৃষিপণ্য কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এ বার উৎপাদন বেশি। আরও দাম কমলে চাষিরা সমস্যায় পড়বেন। তাই সরকার চাষিদের থেকে ৫০ হাজার টন আলু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা বাদে, ব্যবসায়ীরা দু’লক্ষ টন আলু চাষিদের কাছ থেকে কিনে ভিন্ রাজ্যে বা অন্য দেশে পাঠাতে পারবেন।”
আলু বাইরে পাঠানোর ব্যাপারে যাতে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য তাঁর সরকার ব্যবসায়ীদের ১০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেবে বলেও জানিয়েছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠাতে গেলে রেলের ওয়াগন লাগে। অন্য দেশে পাঠানোর জন্য জাহাজে জায়গা ভাড়া করতে হয়। সরকার সেই কাজে ভর্তুকি দিয়ে সাহায্য করবে। ফলে পরিবহণ খরচ কিছুটা কমবে। স্কুলের মিড-ডে মিল ও অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পেও সরকারের কেনা আলু কাজে লাগানো হবে।
শুধু চাষি নয়। হিমঘর মালিকদের দিকটিও নতুন করে বিবেচনা করেছে সরকার। এখন হিমঘরে আলু রাখতে গেলে কেজি পিছু চাষিদের এক টাকা ২০ পয়সা ভাড়া দিতে হয়। এ দিন দক্ষিণবঙ্গের হিমঘরগুলির জন্য কেজি পিছু ১৪ পয়সা এবং উত্তরবঙ্গের জন্য কেজি পিছু ১৬ পয়সা করে ভাড়া বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হিমঘর মালিকেরা বহু দিন ধরেই ভাড়া বাড়ানোর দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু আমরা গত দু’বছর তা বাড়াইনি। হিমঘর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাওয়ায় এ বার সামান্য কিছু ভাড়া বাড়ানো হল।”
বিভিন্ন জেলায় হিমঘরে আলু রাখতে গিয়ে চাষিরা যে বন্ড পাচ্ছেন না, সেই সমস্যার কী সুরাহা হবে?
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, হিমঘরে আলু রাখার ব্যাপারে চাষিদেরই আগে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ১০০ ভাগের মধ্যে ৯৮ ভাগ জায়গাই তাঁদের জন্য বরাদ্দ। তিনি বলেন, “আলু উৎপাদন বেশি হওয়ায় জায়গা নিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে। সরকার আলু কিনতে শুরু করার পাশাপাশি ভিন্ রাজ্যে আলু যেতে শুরু করলে সেই সমস্যা থাকবে না। ভারসাম্য ফিরে আসবে।”
প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে চাষি ও ব্যবসায়ীদের বড় অংশেরই দাবি, ৫০ কেজির বস্তা পিছু অন্তত ৩০০ টাকা সহায়ক মূল্যে আলু কিনতে হবে রাজ্য সরকারকে। আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডলের মতো কৃষক নেতারা আবার মনে করছেন, “ক্ষুদ্র চাষির পক্ষে একা ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানো সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy