Advertisement
১৯ মে ২০২৪

উপাচার্য-বিল আটকে দিলেন শিক্ষামন্ত্রীই

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা নিজেদের হাতে আনতে গিয়েও পিছিয়ে এল তৃণমূল সরকার। উপাচার্য বাছাইয়ে সরকারের পছন্দ-অপছন্দই যাতে একমাত্র নির্ণায়ক হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়ে আইন সংশোধনের জন্য বিল আনার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। সেই বিল বিধানসভায় বিলিও করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিতর্কের প্রেক্ষিতে বুধবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, ওই বিল এখন আনা হচ্ছে না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৩
Share: Save:

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা নিজেদের হাতে আনতে গিয়েও পিছিয়ে এল তৃণমূল সরকার। উপাচার্য বাছাইয়ে সরকারের পছন্দ-অপছন্দই যাতে একমাত্র নির্ণায়ক হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়ে আইন সংশোধনের জন্য বিল আনার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। সেই বিল বিধানসভায় বিলিও করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিতর্কের প্রেক্ষিতে বুধবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, ওই বিল এখন আনা হচ্ছে না।

শিক্ষা মহল এবং বিরোধীদের মতে, সরকার তার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে গেলে শিক্ষায় দলতন্ত্রের সিলমোহর আরও প্রকট হতো। আবার শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্তে মুখ পুড়ল সেই সরকারেরই!

বর্তমান আইন অনুযায়ী শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে উপাচার্য বাছাই করেন আচার্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বাছাইয়ে সরকারের পছন্দ-অপছন্দ যে শেষ কথা, সেটাই প্রায় অলিখিত নিয়ম! তবু কাগজে-কলমে আইনি পদ্ধতি হল, উপাচার্য বাছাইয়ের জন্য গঠিত সার্চ কমিটি তিনটি নাম সুপারিশ করে পাঠায় আচার্য অর্থাৎ রাজ্যপালের কাছে। তার মধ্যে থেকে একটি নাম বেছে নেন রাজ্যপাল। কিন্তু এ বার ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৪’ এনে রাজ্য সরকার বলতে চেয়েছিল, সার্চ কমিটির পাঠানো তিনটি নামের মধ্যে থেকে একটি নাম বেছে নিয়ে রাজ্যপালকে জানাবেন স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীই! অর্থাৎ উপাচার্য নিয়োগে রাজ্য সরকারের পছন্দে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর বসানো ছাড়া আচার্যের আর ক্ষমতা থাকবে না। এমন বিলের পরিকল্পনার কথা জানাজানি হতেই দিনভর সমালোচনার ঝড় ওঠে বিদ্বজ্জন ও রাজনৈতিক শিবিরে। বলা হচ্ছিল, বাম জমানার ‘অনিলায়ন’কেও বহু গুণে ছাড়িয়ে যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার! সরব হন অনুপ সিংহ, অমল মুখোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষাবিদেরা। এ সবের প্রেক্ষিতে এ দিন রাতে শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু বলেন, “সরকার যা করতে চেয়েছিল, তা ওই বিলে নেই। ভুল হয়েছে। এখন ওই বিল আর আনা হচ্ছে না।”

বিতর্কের জেরে তাঁরা পিছিয়ে এসেছেন, এমন ব্যাখ্যা অবশ্য মানতে নারাজ শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর ব্যাখ্যা, বিলের খসড়াতেই গুরুতর ভুল হয়ে গিয়েছে। তাঁরা চেয়েছিলেন, সার্চ কমিটি রাজ্যপালের কাছে সরাসরি উপাচার্যের প্যানেল জমা না দিয়ে শিক্ষা দফতরের কাছে নিয়ে আসবে। তার পরে শিক্ষা দফতর প্যানেল নিয়ে যাবে রাজ্যপালের কাছে। সেখানে তিন জনের মধ্যে এক জনকে শিক্ষামন্ত্রীর বেছে নেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু বিলের খসড়ায় সেটাই লেখা হয়েছে এবং তাতে গোটা বিষয়টি সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। তাই আপাতত ওই বিল নিয়ে না এগোনোর সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, তৃণমূলের সাড়ে তিন বছরের জমানায় এই নিয়ে দ্বিতীয় বার বিল বিধায়কদের মধ্যে বিলি করেও তুলে নিতে হচ্ছে।

শিক্ষা মহলের বড় অংশই মনে করছে, এখন বিলের খসড়ায় ভুলের কথা বললেও এই ভ্রান্তি-বিলাসের দায় শিক্ষামন্ত্রীরই! তৃণমূলেরও একাংশের বক্তব্য, উপাচার্যের মতো শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারের রাশ একেবারে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না পার্থবাবু। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে আসার আগেও সরকারের অন্দরে তিনি এই নিয়ে সওয়াল করেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর আমলে যখন সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনীর উপরে আবার সংশোধনী করা হয়, সেই সময়েই সরকারের নিয়ন্ত্রণ একেবারে আলগা করার বিপক্ষে কথা বলেছিলেন পার্থবাবু। এখন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে সেই কাজই তিনি আইনি পথে করতে গিয়েছিলেন এবং বিড়ম্বনায় পড়ে পিছিয়ে এসেছেন বলে সমালোচকদের মত।

প্রশ্ন উঠছে, খসড়ায় এমন ‘ভুল’ সংবলিত বিল তৈরি হল কী ভাবে? শিক্ষা দফতর সূত্রের দাবি, বিলের মূল খসড়ায় শিক্ষামন্ত্রী সই করার পরে তা নিয়ম মেনে পাঠানো হয় লিগ্যাল রিমেমব্র্যান্স শাখায়। পরে শিক্ষামন্ত্রীর নজরে আসে, খসড়ায় ভুল রয়েছে। তখন তিনি সংশোধনের জন্য নিজের দফতরে ‘নোট’ দিয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে দেরি হয়ে গিয়েছে। ‘ভুল’ সামলানোর আগেই বিল ছেপে বিধানসভার সচিবালয়ের মাধ্যমে বিধায়কদের হাতে পৌঁছে গিয়েছে। যদিও এই ব্যাখ্যাকে ‘অতি সরলীকরণ’ মনে করছে প্রশাসনিক মহলেরই একাংশ। প্রশ্ন থাকছে, সার্চ কমিটির দেওয়া নামের প্যানেল শিক্ষা দফতর ঘুরে রাজ্যপালের কাছে পাঠানোর দরকারই বা কী ছিল? যার জন্য বিলের পরিকল্পনা হয়েছিল বলে শিক্ষামন্ত্রীর যুক্তি। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়-সহ নানা ক্ষেত্রে অজস্র ঘটনায় প্রতিদিন বিব্রত হতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ। সরকারকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে অথচ প্রয়োজনীয় অধিকার তাদের নেই। সেই অধিকারই হাতে পেতে চেয়ে এমন বিলের ভাবনা। পার্থবাবুর কথায়, “একে যদি দলতন্ত্র বলা হয়, তা হলে বলব এই দলতন্ত্র প্রয়োজনীয়! শিক্ষা দফতর জানবে না, আর সব কিছু ঘটে যাবে, এটা হতে পারে না!”

সরকার পিছিয়ে আসার পরেও বিরোধীরা তাদের নিশানা করতে ছাড়ছে না। কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, “বিলে যা লেখা ছিল, সেটাই আসল উদ্দেশ্য। এখন ধরা পড়ে ওঁরা পিছিয়ে আসছেন। বিল না আনার কথা বলে ওঁরা নিজেদের ভুলের স্বীকৃতি দিলেন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE