Advertisement
১৬ মে ২০২৪

এজলাসে অভব্যতার রিপোর্ট চাইল হাইকোর্ট

আইনের আঙিনায় অরাজকতার দাপটে উচ্চ আদালত নড়েচড়ে বসল। সোমবার কলকাতার আলিপুর আদালতে রীতি-নীতি-শালীনতার তোয়াক্কা না-করে এক দল আইনজীবীর অভব্য আচরণ সম্পর্কে এ বার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে চলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। ওখানে ঠিক কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইতিমধ্যে আলিপুরের জেলা জজের রিপোর্ট তলব করেছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

আইনের আঙিনায় অরাজকতার দাপটে উচ্চ আদালত নড়েচড়ে বসল। সোমবার কলকাতার আলিপুর আদালতে রীতি-নীতি-শালীনতার তোয়াক্কা না-করে এক দল আইনজীবীর অভব্য আচরণ সম্পর্কে এ বার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে চলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। ওখানে ঠিক কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইতিমধ্যে আলিপুরের জেলা জজের রিপোর্ট তলব করেছেন।

সারদা রিয়েলটি-মামলায় সিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ নম্বর ধারাটি যাতে যুক্ত করা না যায়, সে জন্য সোমবার আলিপুর কোর্টে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিলেন তৃণমূলপন্থী এক দল আইনজীবী। অভিযোগ, ধারাটি জুড়লে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের জামিনলাভ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বুঝেই তাঁদের এ হেন আচরণ। আলিপুরের বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায় অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে উল্লিখিত মামলায় ৪০৯ যুক্ত করেন। কিন্তু তার আগে প্রতিবাদীরা বিচারকের উদ্দেশে যে ভাষা প্রয়োগ করে গিয়েছেন এবং যে ভাবে প্রায় চার ঘণ্টা বিচার প্রক্রিয়া স্তব্ধ করে রেখেছেন, তাতে সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠেছে।

তার রেশ মঙ্গলবার হাইকোর্টেও পৌঁছেছে। এ দিন হাইকোর্ট বসতেই প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আলিপুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর তখন জানিয়ে দেন, ওই ঘটনায় হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে এ দিন বিকেলে আলিপুরের জেলা জজ সমরেশপ্রসাদ চৌধুরীর কাছে প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছেন, সোমবার বিচারক মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে ঠিক কী ঘটেছিল।

হাইকোর্ট ঠিক কী ব্যবস্থা নেবে, প্রধান বিচারপতি এ দিন তা খোলসা করেননি। তবে আইনজীবীদের একাংশের দাবি: বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আমজনতার আস্থা যাতে বজায় থাকে, সে জন্য উচ্ছৃঙ্খল আইনজীবীদের চিহ্নিত করে তাঁদের নামে আদালত অবমাননার মামলা করতে হবে।

এবং নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই হাইকোর্টের তরফে এমন কঠোর পদক্ষেপ জরুরি বলে এই মহল মনে করছে। ওঁদের পর্যবেক্ষণ, শ্রীরামপুর কোর্টে এক বিচারককে হেনস্থা ও মাসাধিক কাল তাঁর এজলাস বয়কটের ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের ভূমিকা ইতিমধ্যে সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিন শ্রীরামপুরের এক আইনজীবীর আক্ষেপ, “৭ জানুয়ারি থেকে এখানে এক বিচারকের এজলাস বয়কট করা হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে। সংশ্লিষ্ট বিচারককে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলেছেন এক বিচারপতি। রেজিস্ট্রার জেনারেল নিজে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে এসেছেন, কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়েছেন। তবু কাজ হয়নি।”

অর্থাৎ, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপেও শ্রীরামপুর-সঙ্কট কাটেনি। এমতাবস্থায় আইনজীবীদের একাংশ চাইছেন, আলিপুর-কাণ্ডে হাইকোর্ট এমন কিছু ব্যবস্থা নিক, যাতে মানুষের কাছে হাইকোর্টের অবস্থান স্পষ্ট হয়। যা বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণের আস্থার ভিত মজবুত করতে পারে। কী করতে পারে হাইকোর্ট?

আদালত-সূত্রের ইঙ্গিত, হাইকোর্টের প্রশাসনিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটিকে দিয়ে ঘটনার তদন্ত করাতে পারেন প্রধান বিচারপতি। অথবা রেজিস্ট্রার জেনারেল কিংবা রেজিস্ট্রার (ইন্সপেকশন) বা আলিপুর আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত হতে পারে। যেমন শ্রীরামপুরে হাইকোর্টের তরফে হস্তক্ষেপ করেন বিচারপতি নিশীথা মাত্রে। তদন্ত হলে কী ভাবে হবে?

হাইকোর্ট-সূত্রের খবর, তদন্তকারীরা প্রথমে বিচারকের রিপোর্ট চাইবেন, তাঁর বক্তব্য শুনবেন। বসা হবে আলিপুর কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। অভিযুক্ত আইনজীবীদের সঙ্গেও কথা হবে। বার অ্যাসোসিয়েশন ও অভিযুক্তদের বয়ানে সন্তুষ্ট না-হলে ঘটনার জড়িতদের চিহ্নিত করে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করতে পারে হাইকোর্ট। “তাতে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ছ’মাস কারাবাসের বিধান রয়েছে।”— মন্তব্য করেন হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তিনি জানাচ্ছেন, বাম আমলে হাইকোর্টের বিচারপতি অমিতাভ লালাকে ‘বাংলা ছেড়ে পালা’ বলে কটূক্তি করার জন্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর বিরুদ্ধে অবমাননার মামলা হয়। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বিমানবাবুর এক দিনের জেলও হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, চিকিৎসায় গাফিলতির দায়ে ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন যদি বাতিল হতে পারে, তা হলে বিচারে বাধা সৃষ্টি বা বিচারকের চেয়ারকে অপমান করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের লাইসেন্স বাতিল হবে না কেন?

রাজ্য বার কাউন্সিল-সূত্রের ব্যাখ্যা: কোনও আইনজীবীর লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই হাতে। হাইকোর্ট বা অন্য কোনও আদালত বড় জোর কাউন্সিলকে এ ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কাউন্সিলই নেবে।

যদিও আলিপুর-কাণ্ডে তেমন কিছু হওয়ার ইঙ্গিত আপাতত নেই। কাউন্সিল-কর্তাদের বক্তব্য: আলিপুরের গণ্ডগোলের খবর তাঁরা সংবাদমাধ্যম মারফত পেয়েছেন। বিচারক মুখোপাধ্যায় এ দিন রাত পর্যন্ত কাউন্সিলে কোনও অভিযোগ জানাননি। তাঁর অভিযোগ পাওয়া গেলে কাউন্সিল সেই মতো পদক্ষেপ করবে। “কাউন্সিল বৈঠকে বসে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই হবে চূড়ান্ত।”— বলেন কাউন্সিলের এক সদস্য।

হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু মানেন না যে, এ ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্তিয়ার রয়েছে। তাঁর দাবি, বিচারকের সঙ্গে অভব্যতা করার জন্য আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হওয়াটাই যথেষ্ট। তাঁর যুক্তি, “অ্যাডভোকেট অ্যাক্ট অব এথিক্স অনুযায়ী কোনও আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হলে বার কাউন্সিল তাঁর সদস্যপদ খারিজ করতে বাধ্য।”

এ কথা শুনে পাল্টা দৃষ্টান্ত তুলে ধরছেন বার কাউন্সিলের সূত্রটি। তিনি জানিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশে বার অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তা এক বিচারপতিকে এজলাসে গালিগালাজ করায় সুপ্রিম কোর্ট চার বছরের জন্য তাঁর প্র্যাক্টিসে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বার অ্যাসোসিয়েশন সুপ্রিম কোর্টেই তা চ্যালেঞ্জ করে। শীর্ষ আদালত শেষমেশ নিজেদের নির্দেশ প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। “কারণ একমাত্র বার কাউন্সিলই পারে কোনও আইনজীবীকে সাসপেন্ড করতে বা তাঁর লাইসেন্স বাতিল করতে।”— মন্তব্য তাঁর।

তার মানে, এ রাজ্যের বার কাউন্সিল না-চাইলে আলিপুরের ওই আইনজীবীরা পার পেয়ে যেতেই পারেন। হাইকোর্টের এক আইনজীবীর আক্ষেপ, “আলিপুরে এজলাসের ভিতরেই বিচারকের সঙ্গে অভব্যতা করা হয়েছে। ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রী মদন মিত্রের হাজিরার সময়েও ওই আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট বিচারককে হুমকি দিয়েছিলেন।” ওঁদের আশঙ্কা, এর পরেও কোনও প্রতিকার না-হলে বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের আস্থা উবে যাবে।

আর এই সঙ্কটের মুহূর্তে হাল ধরার জন্য হাইকোর্টের দিকেই তাকিয়ে আছে রাজ্যের আইনি মহলের বড় অংশ। বিচারকদের সংগঠন— রাজ্য জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রের খবর, তারাও আলিপুর-কাণ্ডের দিকে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE