দলনেত্রী শত নিষেধ করলেও তৃণমূলের অন্দরে হাঁড়িতে-হাঁড়িতে ঠোকাঠুকি থামছে না। লোকসভায় দলের দুই প্রার্থীর কর্মসূচিতে বুধবার ফের বাধল নেতায়-নেতায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে আরাবুল ইসলাম বনাম কাইজার আহমেদ। বহরমপুরে হুমায়ুন কবীর বনাম জ্যোৎস্না সেন।
যাঁদের সামনে এই ঘটনা, তাঁদের এক জন, যাদবপুরের তৃণমূল প্রার্থী সুগত বসু বলেছেন, “ঠিক কী হয়েছে তা বুঝতে পারিনি। তবে আমি ভাঙড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনব।” বহরমপুরে ইন্দ্রনীল সেনের মন্তব্য, “যার সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে, তার সঙ্গেই মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়। বুঝতে পারছি, হুমায়ুনের সঙ্গে জ্যোৎস্নাদেবীর রাজনৈতিক বন্ধুত্ব রয়েছে।” তবে সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “কর্মিসভা হোক বা অন্য সভা, বক্তব্য রাখার সময়ে ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে কোথায়-কোন প্রসঙ্গ, কতটুকু আনব, তা ভেবে রাখলে ভাল হয়।”
যে লোকসভা ভোটকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাপকাঠিতে কঠিন লড়াই বলে মানছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে কি? তৃণমূলের সবর্ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “আমাদের দলে গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা আছে। তাই সকলের কথা বলার অধিকারও আছে। নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট কেন হবে?”
যদিও টিপ্পনীর সুযোগ ছাড়েননি যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী বা বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরী। সুজনের মন্তব্য, “তৃণমূল প্রার্থীর বাঁ পাশে-ডান পাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাই যদি নিজেদের মধ্যে পেশি ফুলিয়ে মারপিট করেন, তা হলে সন্দেহ হয় এলাকাবাসী কি গণতন্ত্র পাবেন?” অধীরের কথায়, “তৃণমূলে এই কেত্তন লেগেই আছে। মানুষ সবই দেখে বিচার করবেন!”
লোকসভা ভোট ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর আসছে শাসকদলের অন্তর্কলহের। মালদহে দুই দলীয় প্রার্থীর সামনেই কর্মিসভায় রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মদতের অভিযোগ করেন জেলার আর এক মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র। দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলিতে কর্মিসভার দিন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হন দুই তৃণমূল কর্মী। যার জেরে মঙ্গলবারই এক যুব নেতাকে বহিষ্কার ও চার নেতা-কর্মীকে সাসপেন্ড করে দল। তৃণমূল সূত্রের দাবি, সব ঝামেলার পিছনেই দলের জেলা-নেতাদের পুরনো বিবাদ রয়েছে।
আরাবুল-কাইজার গোষ্ঠীর বিবাদও ভাঙড়ে নতুন নয়। আরাবুল প্রাক্তন বিধায়ক ও ভাঙড় ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। কাইজার জেলা পরিষদের সদস্য। মাস দু’য়েক আগে এক সভায় যুবার সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সামনে মঞ্চেই হাতাহাতি হয়েছিল দু’জনের। পরে পৈলানে লোকসভা ভোটের প্রথম কর্মিসভায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থামানোর বার্তা দেন খোদ মমতা।
এ দিন সমস্যা হয় ভাঙড়ের কাঁঠালিয়া বাসস্ট্যান্ডের কর্মিসভার শেষে, সুগত বসুর মিছিলের শুরুতে। জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, সুগতবাবুর পাশে হাঁটছিলেন কাইজার। তাই দেখে প্রথমে আরাবুল, পরে তাঁর ছেলে হাকিবুল গালিগালাজ শুরু করেন কাইজারকে। ধস্তাধস্তি শুরু হয় দুই নেতার ঘনিষ্ঠদের মধ্যেও। আরাবুলকে সরিয়ে নিয়ে যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত যাদবপুর কেন্দ্রের দলীয় পর্যবেক্ষক অরূপ বিশ্বাস। অরূপ অবশ্য বলছেন, “আরে ও সব কিছু না। কয়েক জন যুবক সুগতদার সঙ্গে যাবে বলে তাড়াহুড়ো করছিল। তাই চেঁচামেচি।” আরাবুলের দাবি, “গরমের জন্য মিছিলে যাইনি। অরূপদা অবশ্য সে সব না শুনে টানাটানি করছিলেন।” কাইজারের মন্তব্য, “আমি প্রার্থীকে নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। কেউ গালাগালি দিচ্ছিল তা কানে এসেছে। আর কিছু জানি না।”
বহরমপুরে সিরাজবাগে তৃণমূলের কর্মিসভায় অবশ্য যুযুধান দু’পক্ষের কথা হয়। প্রায় দু’শো কর্মীর সামনেই কথা কাটাকাটি হয় প্রাক্তন মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর এবং নওদা বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না সেনের। এ দিনের কর্মিসভার কথা তাঁকে জানানো হয়নি বলে সভায় সরব হন জ্যোৎস্নাদেবী। হুমায়ুন পাল্টা বলেন, “মাসখানেক আগে জ্যোৎস্নাদেবীকে চেয়ারম্যান করে নওদা বিধানসভা নির্বাচনী কমিটি তৈরি করেছি। কিন্তু তিনি ওই কমিটি মানেন না। চেয়্যারম্যান পদেও থাকতে চান না। ফলে, তাঁকে ইচ্ছাকৃত ভাবে কর্মিসভার কথা জানাইনি।” তখন উঠে এসে জ্যোৎস্নাদেবী ‘আমার কিছু বলার আছে, আমাকেও বলতে দিতে হবে’ বলে দাবি করেন। তর্জনী তুলে হুমায়ুনকে বলতে শোনা যায়, “চুপচাপ গিয়ে চেয়ারে বসুন।”
জ্যোৎস্না পরে বলেন, “আমাকে চেয়ারম্যান করে কমিটি হল, অথচ আমি তা জানলাম না! কিছুতেই আমার মতও নেওয়া হয়নি। আশা করছি, আলোচনায় সমস্যা মিটবে।” হুমায়ুনের বক্তব্য, “হাঁড়ি থাকলে ঠোকাঠুকি হয়। এক জায়গায় দু’-পাঁচশো লোকের জমায়েত হলে ছোটখাটো ঘটনা ঘটেই থাকে। উত্তেজনার কিছু হয়নি।”
তাই কি? ইন্দ্রনীল তো সভায় বলেছেন, “হুমায়ুনের বক্তব্য শুনে আঁচ করতে পারছি, বাইরে কতটা গরম পড়েছে। ১২ মে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত ওই তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিতে গিয়ে ঠেকবে।”