কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখা হলে প্রবাদ কটাক্ষ করতে ছাড়ে না। ‘খোঁড়া’ শিশু কল্যাণ সমিতিকে ‘মডেল’ তকমা দিলে কী বলা হবে?
যে যা-ই বলুক, এমনটাই হতে চলেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শিশু কল্যাণ সমিতিতে। যদিও আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সংখ্যায় সদস্য না-থাকায় সমিতিটি প্রায় নিষ্ক্রিয়। যেটুকু যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, ন্যূনতম সংখ্যক সদস্যের অনুমোদনের সুযোগ না-থাকায় তা বাতিলও হতে পারে।
আইন অনুযায়ী সদস্য থাকার কথা পাঁচ জন। কিন্তু ওই সমিতিতে খাতায়-কলমে সদস্য আছেন দু’জন। চেয়ারম্যান অরবিন্দ দাশগুপ্ত এবং এক জন মহিলা। চেয়ারম্যান তো অধিকাংশ সময়েই থাকতে পারেন না। কোনও বৈঠকে ‘কোরাম’ (ন্যূনতম সদস্যের উপস্থিতি) হতে গেলে তিন সদস্য
থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাকুল্যে সদস্য তো দু’জন। তাই সমিতির কোনও বৈঠকেই কোরাম হচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এক জন সদস্য সই করলেই চলে। তবে আইন অনুসারে পরের দিনই
সেই সিদ্ধান্ত বাকি সদস্যদের দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার কথা। সেটাও হচ্ছে না।
এই ভাবেই আইনের শর্ত না-মেনে কয়েক মাস ধরে খুঁড়িয়ে চলছে ওই শিশু কল্যাণ সমিতি। যদি এটাকে আদৌ ‘চলা’ বলা যায়! রাজ্য সরকার এই অবস্থাতেই এটিকে শিশু কল্যাণের ‘মডেল’ সমিতি হিসেবে তুলে ধরতে চলেছে। লোকবল না-থাকুক, বহিরঙ্গে বদল এনে, রংচং করে, সাজিয়েগুজিয়ে সমিতিটিকে ‘শিশু-বান্ধব’ করে তোলার কাজ চলছে। ২৭ নভেম্বর, শুক্রবার এই ‘মডেল কেন্দ্র’-এর উদ্বোধন করার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
অথচ রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রেরই বক্তব্য, এ বছর ওই সমিতির নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রায় ৯০ শতাংশ এক মহিলা সদস্য একাই নিয়েছেন। ওই সব সিদ্ধান্তে সই আছে শুধু তাঁরই। ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট’ না-মেনে ওই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং সে-ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটির প্রসঙ্গ তুলে কেউ আদালতে গেলে ওই সব সিদ্ধান্তই বাতিল হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দফতরের কর্তাদের একাংশ। তাঁদের প্রশ্ন, যে-সমিতির অধিকাংশ সিদ্ধান্তের আইনি ভিত্তি নড়বড়ে, বেছে বেছে সেই সমিতিকেই ‘মডেল’ করা হচ্ছে কেন?
নড়বড়ে সিদ্ধান্তগুলো কেমন?
দক্ষিণ গোয়া শিশু কল্যাণ সমিতি সম্প্রতি দু’টি শিশুর খবর চেয়ে চিঠি দিয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার ওই সমিতিকে। শিশু দু’টির বাবাকে খুনের দায়ে তাদের মা এখন গোয়ার জেলে। নিহতের ভাই ইছাপুরের বাসিন্দা। তাঁকেই শিশু
দু’টির দায়িত্ব দিয়েছিল গোয়ার সমিতি। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে শিশু দু’টির খোঁজ নেই। গোয়ার চিঠির প্রেক্ষিতে এই নিয়ে তদন্ত চেয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার ওই সমিতির একমাত্র মহিলা সদস্য।
চার দিন আগে বনগাঁ লোকাল থেকে বাংলাদেশের এক নাবালিকাকে উদ্ধার করা হয়। কে বা কারা তাকে হাওড়ার গাদিয়াড়ার এক হোটেলে বেচে দিয়েছিল। শিশু কল্যাণ সমিতির ওই মহিলা সদস্য একাই সেই ব্যাপারে পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনিই একক সিদ্ধান্তে হোমে পাঠিয়েছেন ওই বালিকাকে।
দফতরের বক্তব্য, এই সব সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে বাতিল হতে পারে।
ওই সমিতির এমন হাল হল কেন?
ফেব্রুয়ারিতে চেয়ারম্যান-সহ পাঁচ জন সদস্য নিয়েই সমিতি গড়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে তিন জন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও কাউন্সিলর হওয়ায় সমিতিতে সময় দিতে পারতেন না। তাই মার্চের পরে তাঁরা পরপর ইস্তফা দেন। চেয়ারম্যান অরবিন্দবাবু শাসক দলের নেতা, বেশির ভাগ সময়েই জেলার বাইরে থাকেন। ফলে সমিতির সদস্য-সংখ্যা কার্যত এক জনে এসে ঠেকেছে।
তবে এমন একটি সমিতিকে মডেল করার মধ্যে ভুল কিছু দেখছেন না দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা। তিনি জোর দিচ্ছেন সমিতির ঘরদোরের চেহারা বদলের উপরেই। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ওই সমিতির ঘরগুলিকে ‘চাইল্ড-ফ্রেন্ডলি’ বা শিশু-বান্ধব করেই গড়ে তুলছি। এই পরিস্থিতিতে সমিতিতে পর্যাপ্ত সদস্য থাকা বা না-থাকার কথা আসছে কেন?’’
সমিতির ঘরগুলিকে কী ভাবে শিশু-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকাতেই তা বলা আছে। ওই নির্দেশিকা বলছে: l বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করে আনা শিশুদের যে-সব ঘরে রাখা হবে, সেগুলোর দেওয়াল জুড়ে সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে রাখতে হবে। যাতে বাচ্চারা আনন্দ পায়। l শিশুদের বসার জন্য রাখতে হবে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল। l বাচ্চাদের জন্য থাকবে ছবির বই, খাতা, পেন্সিল।
শিশুদের কাউন্সেলিং করবেন সমিতির সদস্যেরাই। তবে তার জন্য সমিতি ভবনে আলাদা ঘর চাই।
উত্তর ২৪ পরগনার শিশু কল্যাণ সমিতি সেই ভাবেই সেজে উঠছে। কিন্তু লোকবল তথা সদস্য-সংখ্যার আইনটাই যে মানা হচ্ছে না! ‘মডেল’ বা আদর্শ তকমা দেওয়ার জন্য আর কি কোনও সমিতি পাওয়া গেল না?
দফতরের এক কর্তার যুক্তি, ‘‘স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য নিয়ে ওই সমিতিকে নতুন রূপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই সংস্থা কলকাতায় নয়, বিভিন্ন জেলায় কাজ করে। কলকাতার সব চেয়ে কাছের জেলার সমিতি হিসেবেই উত্তর ২৪ পরগনার ওই সমিতিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।’’
সে-ক্ষেত্রে আগে পাঁচ জন পুরো সময়ের সদস্য নিয়ে ওই সমিতিকে নতুন ভাবে গড়ে তুলে পরে কি তার বাইরের চেহারায় বদল এনে ‘মডেল’ হিসেবে তুলে ধরা যেত না?
দফতরের কর্তারা নিরুত্তর। আর রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান অশোকেন্দু সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘আইন অনুসারে ন্যূনতম সদস্য না-থাকা সত্ত্বেও যদি সমিতিকে মডেল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে সেটা ঠিক হয়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy