Advertisement
E-Paper

খনি থেকে বিদ্যুতের কয়লা লুটছে বাইকবাহিনী, আশঙ্কায় সিইএসসি

প্রায় নিত্য দিন মোটরবাইক আরোহী লুটেরাবাহিনীর হানা। অস্ত্র উঁচিয়ে রক্ষীদের চুপ করিয়ে দিনে-দুপুরে খনি থেকে টন টন কয়লা লোপাট, পরিণতিতে কলকাতা ও আশপাশে দৈনন্দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার জোগাড়। কিন্তু তাতেও ঘুম ভাঙছে না স্থানীয় প্রশাসনের!

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫৫
বারাবনির খনি থেকে প্রকাশ্যে চলছে কয়লা লুঠ। —নিজস্ব চিত্র।

বারাবনির খনি থেকে প্রকাশ্যে চলছে কয়লা লুঠ। —নিজস্ব চিত্র।

প্রায় নিত্য দিন মোটরবাইক আরোহী লুটেরাবাহিনীর হানা। অস্ত্র উঁচিয়ে রক্ষীদের চুপ করিয়ে দিনে-দুপুরে খনি থেকে টন টন কয়লা লোপাট, পরিণতিতে কলকাতা ও আশপাশে দৈনন্দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার জোগাড়। কিন্তু তাতেও ঘুম ভাঙছে না স্থানীয় প্রশাসনের!

অগত্যা বাধ্য হয়ে রাজ্য প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছে আরপি সঞ্জীব গোয়েন্কা গোষ্ঠী, যাদের সংস্থা সিইএসসি’র উপরে কলকাতায় বিদ্যুৎ জোগানের ভার। তাদের অভিযোগ, গত এক বছর ধরে আসানসোলের বারাবনি থানা-এলাকার সরিষাতলি খনিতে লাগাতার কয়লা চুরির বিহিত চেয়েও সাড়া মেলেনি। ওই খনি থেকেই সিইএসসি’র বিভিন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা যায়। গোয়েন্কা গোষ্ঠীর বক্তব্য: এখনই চুরি থামানো না-গেলে কয়লার অভাবে সিইএসসি’র বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। ফলে ভরা গ্রীষ্মে কলকাতা শহরে ফের লোডশেডিংয়ের দাপট বাড়ার সমূহ আশঙ্কা।

এমতাবস্থায় জেলা প্রশাসনকে অবিলম্বে সক্রিয় করে তুলতে রাজ্য সরকারকে আর্জি জানানো হয়েছে। কয়লার পাশাপাশি জল চুরির নালিশও পেশ করা হয়েছে রাজ্য প্রশাসনের দরবারে। গোয়েন্কা গোষ্ঠীর অভিযোগ: ওই তল্লাটে সিইএসসি-র চল্লিশ মেগাওয়াটের তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পাঁচ কিলোমিটার দূরের অজয় নদ থেকে জল আনার যে পাইপলাইন, তা ফাটিয়ে দেদার জল চুরি করা হচ্ছে। জল সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মদনপুর গ্রামের কাছে পাইপ ফাটিয়ে জল চুরির জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দিকে আঙুল তুলে সংস্থার দাবি, এর পিছনে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতার মদত রয়েছে।

রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য?

সরকার অবশ্য অভিযোগটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ জারি হয়েছে। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “অভিযোগ গুরুত্বপূর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নির্দেশ ছিল, আসানসোল অঞ্চলে চোরাই কয়লার কারবার বন্ধ করতে হবে। তা সত্ত্বেও কী ভাবে এ সব ঘটছে, জেলা প্রশাসনের কাছে তা জানতে চাওয়া হবে। বেআইনি কারবার অবিলম্বে বন্ধ করতে বলা হয়েছে।” স্থানীয় প্রশাসন বা পুলিশের প্রতিক্রিয়া?

সিইএসসি-র অভিযোগ প্রসঙ্গে বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের মন্তব্য, “এমন ঘটনার কথা জানা নেই। আসানসোলের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলব।” আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। আসানসোলের পুলিশ কমিশনারকে বলা হয়েছে, যে ভাবেই হোক চুরি বন্ধ করতে হবে।” কৃষিমন্ত্রী তথা আসানসোলের দাপুটে তৃণমূল নেতা মলয় ঘটকও কয়লা চুরি সম্পর্কে জানেন। “আমরা ক্ষমতায় এসে অবৈধ খাদান থেকে কয়লা তোলা বন্ধ করে দিয়েছি। তাই প্রায় রোজ দু’শো-আড়াইশো মোটরসাইকেল নিয়ে বারাবনির খনিটিতে হানা চলছে।” জানান তিনি। মলয়বাবুর আক্ষেপ, “কয়লা নিয়ে ওরা অজয় পেরিয়ে বীরভূমে পালাচ্ছে। ভয়াবহ অবস্থা! বার বার পুলিশকে বলেও চুরি রোখা যাচ্ছে না।”

আরপি সঞ্জীব গোয়েন্কা গোষ্ঠী সূত্রের খবর, বারাবনির সরিষাতলির খোলা-মুখ খনিটি থেকে গত সাত বছর ধরে কয়লা উত্তোলন হচ্ছে। এ যাবৎ প্রায় ৩০ লক্ষ টন কয়লা তোলা হয়েছে। গোয়েন্কা গোষ্ঠীর অধীনস্থ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড কোল মাইনিং লিমিটেড (আইসিএমএল)-এর নামে সেটি লিজ নেওয়া আছে। সিইএসসি-র বজবজ তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের দু’টো ইউনিট ছাড়াও টিটাগড় ও সাঁওতালডিহি কেন্দ্রে কয়লা যায় এখান থেকেই।

আর কয়লার সেই উৎসস্থলেই এমন দিনে ডাকাতির হিড়িকে গোয়েন্কা গোষ্ঠী প্রমাদ গুনছে। খনির এক কর্তার কথায়, “এ তো বর্গির হানা! আচমকা শ’খানেক মোটরবাইক এসে হাজির। আরোহীদের সঙ্গে নানা হাতিয়ার। বস্তার মধ্যে কয়লা ভরতে থাকে। এক-একটা বাইকে তিন থেকে পাঁচ বস্তা (প্রায় তিন কুইন্টাল) কয়লা নিয়ে ফিরে যায়।” তাঁর মন্তব্য, “রাতের অন্ধকারে তো নয়! দিনের আলোয় সকলের চোখের সামনে লুঠপাট চলছে। পুলিশ-প্রশাসন সব জেনেও চুপ!”

আরপি সঞ্জীব গোয়েন্কা গোষ্ঠীর তরফে জানানো হয়েছে, গত সাত মাসে অন্তত চার বার এ নিয়ে বারাবনি থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। ২০১৩-র ২৯ অগস্ট দায়ের করা অভিযোগটিতে বলা হয়েছিল, আগের দিন (অর্থাৎ ২৮ অগস্ট, ২০১৩) বেলা দু’টো থেকে পাঁচটার মধ্যে তিনশো টন কয়লা লুট করে নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। গোটা আশি মোটরবাইক ও শ’দুই সাইকেল নিয়ে লুটেরার দল চড়াও হয়েছিল। অভিযোগে পুলিশকে এ-ও জানানো হয়, খনিতে মোতায়েন গুটি কয়েক বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর পক্ষে কয়েকশো হানাদারকে ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রতিরোধ করতে গেলে বড় ধরনের গোলমাল হতে পারে বলেও অভিযোগে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

গোয়েন্কা গোষ্ঠীর দাবি: ২৯ অগস্টের অভিযোগের পরে পুলিশ কিছুটা সক্রিয় হলেও ইদানীং আবার প্রায় রোজই খনিতে হানাদারি চলছে। “সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ওরা আসছে। কখনও দিনে দু’বারও।” বলছেন খনি-কর্তাটি। গোয়েন্কা গোষ্ঠী-সূত্রের বক্তব্য, গত ৩ ও ৩০ জানুয়ারি খনি-কর্তৃপক্ষের তরফে থানায় লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি আরও এক বার। কাজের কাজ কিছু হয়নি। খনির এক অফিসার বলেন, “কয়লা চুরি যাওয়ায় সরকারও রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দৈনিক মোটা রাজস্ব হারাচ্ছে রাজ্য।”

শেষ চেষ্টা হিসাবে তাই ওঁরা স্বরাষ্ট্র দফতরকে সব জানিয়েছেন। এখন ফলের অপেক্ষা।

jagannath chattopadhayay cesc coal mine
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy