Advertisement
০৮ মে ২০২৪
পুরভোটের আগে আশঙ্কা বিজেপি-ই

ঘর সামলান, মমতা বললেন বিমানদের

মেলালেন তিনি মেলালেন! যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে এনে দিলেন সৌহার্দ্যের বাতাবরণ! তিনি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী! মোদী হাওয়ায় রাজ্যে বিজেপি-র উত্থান চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তৃণমূল এবং বাম, দু’পক্ষকেই। বামেদের ভোটব্যাঙ্ক ভেঙে বিজেপি-তে গিয়েছে। তৃণমূলের ততটা ক্ষতি না হলেও কলকাতা ও তার লাগোয়া এলাকায় তারা চাপে। এই আবহেই সোমবার সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে নিজের ঘরে সাদর আপ্যায়ন করলেন বিমান বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দলকে।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে বিমান বসু-সহ বাম প্রতিনিধিরা। রয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে। ছবি: সুদীপ আচার্য

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে বিমান বসু-সহ বাম প্রতিনিধিরা। রয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে। ছবি: সুদীপ আচার্য

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০৩:৪১
Share: Save:

মেলালেন তিনি মেলালেন! যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে এনে দিলেন সৌহার্দ্যের বাতাবরণ!

তিনি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী!

মোদী হাওয়ায় রাজ্যে বিজেপি-র উত্থান চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তৃণমূল এবং বাম, দু’পক্ষকেই। বামেদের ভোটব্যাঙ্ক ভেঙে বিজেপি-তে গিয়েছে। তৃণমূলের ততটা ক্ষতি না হলেও কলকাতা ও তার লাগোয়া এলাকায় তারা চাপে। এই আবহেই সোমবার সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে নিজের ঘরে সাদর আপ্যায়ন করলেন বিমান বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দলকে। ফিশফ্রাই, ক্রিমরোল আর দার্জিলিং চা-সহযোগে দু’পক্ষে ঘণ্টাখানেক ধরে আলোচনা হল, এ রাজ্যে বিজেপির উত্থান নিয়ে।

বস্তুত এ দিন সন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেকের ওই বৈঠকই দৃশ্যত এলোমেলো করে দিয়েছে রাজ্য রাজনীতির দীর্ঘকালের চেনা সমীকরণ! সাড়ে তিন দশকের মৌরসীপাট্টা ভেঙে বামেদের ছন্নছাড়া করে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলনেত্রী বিমানবাবুদের পরামর্শ দিয়েছেন আপনাদের ঘর সামলান! জানতে চেয়েছেন, বাম শিবির ছেড়ে দলে দলে লোক বিজেপি-তে যাচ্ছে কেন?

ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস এবং বামেদের আক্রান্ত হওয়ার যে ‘স্পর্শকাতর’ অভিযোগ নিয়ে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন, তার জেরে নবান্নের ১৪ তলার বৈঠকে তেমন কোনও তিক্ততা অনুভব করেননি বিমানবাবুরা! বিমানবাবু যখন হুমকি দিয়েছেন সন্ত্রাস বন্ধ না হলে তাঁরা আন্দোলনের পথে যাবেন তখন যারপরনাই বিস্ময়ের সঙ্গে জবাব শুনেছেন, “নিশ্চয়ই যাবেন! আন্দোলন করাই তো রাজনৈতিক দলের কাজ।”

অথচ এই সে দিনও মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার ভিতরে-বাইরে বামেদের হুঁশিয়ারি দিতেন, “১০ বছর চুপ করে থাকুন! মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগান!” এ দিন সেই মুখ্যমন্ত্রীর মুখেই আন্দোলনে উৎসাহ দেওয়ার কথা শুনে এসে এক বাম নেতার প্রতিক্রিয়া, “যেটা ঘটল, সেটা স্বাভাবিক নয়! এই আচরণ আমাদের সঙ্গে হওয়ার কথাই নয়! আসলে বিজেপি-র বাড়বাড়ন্তে মুখ্যমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। তাই নতুন কৌশল নিয়ে বাম-সহ সব ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে পাশে চাইছেন।” যদিও বৈঠকে উপস্থিত তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “বামেরা দেখা করার জন্য সময় চেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী গণতান্ত্রিক রীতি এবং সৌজন্য মেনে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন!”

মুখ্যমন্ত্রীর সদয় মনোভাব দেখে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব এ দিনের আলোচনায় কায়দা করে রাজারহাটে জ্যোতি বসুর নামে গবেষণাকেন্দ্রের জন্য জমি না-পাওয়ার প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ আশ্বাস দিয়েছেন, বসুর নামে গবেষণাকেন্দ্র জমির জন্য আটকে থাকবে না!

বাম-তৃণমূলের এমন আপাত-অসম্ভব মিতালিকেই সরাসরি কটাক্ষ করেছেন রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর মন্তব্য, “আগেই বলেছিলাম, একটা সেটিং হয়েছে! মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন, যেখানে যেখানে চট-খোলা ভোট (জবরদস্তি) হয়নি, সেখানেই লোকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। বিপদ বুঝতে পেরে উনি এখন সিপিএম-কে ডাকছেন!” তবে বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, বাম-তৃণমূল এমন নৈকট্যে তাঁদের কোনও ক্ষতি নেই। কারণ, নিচুতলার বাম কর্মী-সমর্থকেরা তৃণমূল নেত্রীর কথা শুনে চলবেন, এমনটা ধরে নেওয়া যায় না। আর সত্যিই যদি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা কালীঘাট-আলিমুদ্দিনকে কাছাকাছি এনে দেয়, তা হলেও তৃণমূলে ভাঙন ধরবে এবং লাভবান হবে বিজেপি।

মমতার তিন বছরের জমানায় বামেদের স্মারকলিপি দেওয়ার ভূরি ভূরি আবেদন উপেক্ষায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কিন্তু লোকসভা ভোটের ফলাফলের পরেই তিনি যে বিমানবাবুদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়ে গেলেন, তার নেপথ্যে বিজেপি-র উত্থানের রহস্যই আসল কারণ বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেছিলেন। বিমানবাবু, মঞ্জুকুমার মজুমদার, জয়ন্ত রায়, ক্ষিতি গোস্বামী, রবীন দেব, মিহির বাইন-সহ বাম প্রতিনিধি দলের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেই অনুমান সত্য!

বামেদের মূল দাবি ছিল তিনটি ঘরছাড়াদের ফেরানো, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা। বাম সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে প্রত্যাশিত ভাবেই শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানছিলেন না। দাবি করছিলেন,রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তো আছে! বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু তাঁকে তালিকা দিয়ে দেখান, শাসক দলের হাতে কী ভাবে বামেরা আক্রান্ত। ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা জয়ন্ত রায় বলেন, এ রাজ্যে যদি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে উঠে দাঁড়াতে হয়, তা হলে সর্বাগ্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসা প্রয়োজন। এই কথার সূত্র ধরেই মুখ্যমন্ত্রী সোজা ঢুকে পড়েন বিজেপি প্রসঙ্গে!

সংবাদমাধ্যমের একাংশ বিজেপি-কে বড় করে দেখাচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে এ দিনের বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে খানিক বিষোদ্গার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে বলেছেন, মোদীকে তিনি বুঝে নেবেন! মোদী যদি মোদী হন, তিনিও তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এর পরেই তাঁর প্রশ্ন, বামেদের ছেড়ে এত লোক বিজেপি-তে যাচ্ছে কেন? কেন বামেরা লড়তে পারছে না? বিমানবাবু বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁদের আপসহীন অবস্থান বহু দিনের। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এ রাজ্যে বাড়তে দেওয়া যাবে না। তিনি নিজের কাজ করবেন। বামেরা ঘর সামলাক!

মুখ্যমন্ত্রীই প্রশ্ন তোলেন, বামেদের কার্যালয় কেন বিজেপি দখল করে নিচ্ছে? বিমানবাবু বলতে গিয়েছিলেন, কার্যালয় দখল তো করেছে তৃণমূল! মুখ্যমন্ত্রী আমল দেননি। তাঁর লক্ষ্য বিজেপি-ই। এমনকী, বামেদের নিজের ভোট ধরে রাখতে পারার ব্যর্থতা বোঝাতে মমতা টেনে এনেছেন বহরমপুরের লোকসভা ভোটের ফলের প্রসঙ্গও। প্রশ্ন তুলেছেন, অধীর চৌধুরী এত ভোটে জেতেন কী ভাবে? সিপিএম-আরএসপি’র ভোট না পেলে এই রকম ফল হয়? ক্ষিতিবাবুরা (আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকের শরীর এবং পরিবার নিয়ে এ দিন প্রভূত উদ্বেগ দেখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী) উত্তর দিতে পারেননি!

এই আলোচনার ফাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাব দেন, সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে বামফ্রন্ট ও শাসক দলের মধ্যে সমন্বয় রেখে চলার জন্য দু’দলের দুই নেতাকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হোক। ঠিক হয়, তৃণমূলের তরফে পার্থবাবু এবং বামেদের তরফে রবীনবাবু এই দায়িত্ব পালন করবেন। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ, কখনও কোনও সমস্যা হলে বামেরা সরাসরি পার্থবাবুকে জানাবেন। আর যদি মনে হয় কোনও কথা মুখ্যমন্ত্রীকেই জানাতে হবে, তা হলে সরাসরি ফোন করতে পারেন!

বৈঠক শেষে বিমানবাবু বলেছেন, “আমাদের দলের কর্মী-সমর্থকেরা যে ভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে ফিরতে পারছেন না, খেতের ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছি মুখ্যমন্ত্রীকে। উনি ধৈর্য ধরে সব কথা শুনেছেন। বলেছেন, প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখা হবে।” মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তাঁরা কি আশ্বস্ত? ফ্রন্ট চেয়ারম্যানের জবাব, “আমরা কয়েক দিন অপেক্ষা করব। দেখি কী হয়! না আঁচালে বিশ্বাস নেই!”

নবান্নের লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে বিমানবাবু যখন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, কর্তব্যরত পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীদের কেউ তাঁদের বাধা দেয়নি। অথচ এক সপ্তাহ আগে এই নবান্নেই বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের আগমনে নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে ফেলেছিল পুলিশ। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা আটকাতে পোডিয়ামের ধারেকাছে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি! বিমানবাবুদের জন্য অবশ্য ১৪ তলায় ঘরের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, আর বিদায় জানাতে নীচে নেমে এসেছিলেন পার্থবাবু!

সৌহার্দ্যের এমন ছবি দেখে এ দিন রাত থেকে বামপন্থীদেরই কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, বামফ্রন্ট শেষ! যেটুকু ছিল, নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে তৃণমূল নেত্রীই শেষ করে দিলেন! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের অবশ্য ব্যাখ্যা, “আমাদের পেয়ে উনি ওঁর উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। এতে আমাদের কী করার ছিল?” এক শরিক নেতার আশা, আশ্বাসমাফিক মুখ্যমন্ত্রী যদি সন্ত্রাস ঠেকাতে কিছু পদক্ষেপও করেন, তা হলে কর্মী-সমর্থকদের বাম শিবির-ত্যাগ কিছুটা ঠেকানো যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE