Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জুৎসির সফরেই গতি সিইও দফতরে

এক সফরেই বদলে গেল চিত্রটা! রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কোন নেতা বা প্রার্থী নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। কিন্তু রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সুনীল গুপ্তর কাজকর্ম নিয়ে কার্যক্ষেত্রে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল বিপরীত।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় ও কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

এক সফরেই বদলে গেল চিত্রটা!

রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কোন নেতা বা প্রার্থী নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। কিন্তু রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সুনীল গুপ্তর কাজকর্ম নিয়ে কার্যক্ষেত্রে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল বিপরীত। তাঁরা বলছিলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ এক পদাধিকারীর দফতর যেন হয়ে গিয়েছে ডাকঘর, যার কাজ সীমাবদ্ধ শুধু জেলাশাসক ও দিল্লির জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মধ্যে রিপোর্ট আদানপ্রদানে! সেই কথা তাঁরা জানান উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসিকেও।

গত ২৫ মার্চের বৈঠকে জুৎসিকে যখন বিরোধীরা এ সব অভিযোগ করছেন, তখন সেখানে হাজির ছিলেন সুনীলবাবুও। পরে জেলাশাসকদের সঙ্গে বৈঠকে সিইও-র দফতরের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ নিয়ে সরব হন জুৎসি। জেলা নির্বাচন আধিকারিক হিসেবে জেলাশাসকেরাও যে তাঁদের ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করছেন না, সে কথা মনে করিয়ে দেন তিনি। তাঁদের কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা যে বরদাস্ত করা হবে না, এমন মন্তব্যও জুৎসি ওই বৈঠকে করেছেন বলে সিইও দফতর সূত্রের খবর। সূত্রটি জানিয়েছেন, পরে বিমানবন্দরে জুৎসি নিজে সুনীলবাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। জুৎসির সফরই শেষ নয়। ৫ এপ্রিল রাতে রাজ্যে আসছে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতের নেতৃত্বে তিন নির্বাচন কমিশনারের পুরো দল। রাজ্যের পরিস্থিতি জানতে তাঁরা ওই রাতেই বৈঠক করবেন সুনীলবাবুর সঙ্গে।

জুৎসির সফরের পরে সিইও দফতরের কাজে যে গতি এসেছে, তা দফতরেরই অনেকে মেনে নিচ্ছেন। সিইও সুনীল গুপ্ত নিজেও বলেন, “সিপিএমের ৬২টি অভিযোগের তদন্ত করে সোমবারই দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে তার জবাব দেওয়া হয়েছে। অন্য দলগুলিকেও তাদের অভিযোগের তদন্ত করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা দু’এক দিনের মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে।” বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানায় জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করা হয়েছে। তা নিয়ে সিইও নিজে কথা বলেছেন বর্ধমানের জেলাশাসকের সঙ্গে। তৃণমূলের বিধায়কের বিরুদ্ধে হাবরার বিডিও-র তোলা অভিযোগ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসককে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন সিইও। মঙ্গলকোটে অনুব্রতর ৭ মার্চের করা মন্তব্য নিয়ে এফআইআর করতে এত দিন কেন লাগল? সে ব্যাপারে সিইও-র দফতরের ব্যাখ্যা, অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা সময় লেগে গিয়েছে।

অতীতে সিইও-র দফতরে শীর্ষ পদে থাকা এক আমলার বক্তব্য, সিইও রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি। ফলে, তাঁর মূল কাজ কমিশনের নীতি নির্দেশিকা মেনে ভোট পরিচালনা করা এবং কমিশন যে নির্দেশ দেবে, তা রূপায়ণ করা। কমিশনের নির্দেশ ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না, তা দেখাও সিইও-র কাজ। এ ক্ষেত্রে তাঁর দিল্লির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। যেমন, কেউ সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিলে, মানহানিকর বক্তব্য রাখলে, দিল্লিতে কমিশনের কাছ থেকে নির্দেশ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কী করতে হবে, তা কমিশন ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে। তবে যদি ব্যতিক্রমী কিছু ঘটে বা এমন কিছু হয়, যার জন্য অতীতের নির্দেশিকা নেই, তখন দিল্লির মতামত চাইতে হয়।

কমিশনের কাজ করেছেন, এমন আর এক কর্তাও জানালেন, রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় দিল্লির দিকে তাকিয়ে না থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ারই কথা। সব কিছুতে দিল্লির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে সিইও-র দফতরের প্রতি রাজনৈতিক দলের আস্থা কমবে, বিধিভঙ্গের অভিযোগের পাহাড়ও দিন দিন উঁচু হবে। শেষ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিল্লিরও থাকবে না।

ওই আমলার কথায়, “চিঠি লিখে দিল্লির মত চাইলে তো আরও সময় নষ্ট হয়। আমরা ফোন করে বা নিদেনপক্ষে এসএমএস করে দিল্লির মতামত চাইতাম বা আমরা কী করতে চলেছি, তা জানিয়ে রাখতাম। এতে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নষ্ট হতো না।”

সুনীলবাবু অবশ্য দাবি করেন, তাঁর দফতর কখনওই নিষ্ক্রিয় ছিল না। তাঁর ব্যাখ্যা, “কমিশনের নির্দেশ মেনেই যাবতীয় কাজ করা হচ্ছে। যে অভিযোগ দিল্লিতে পাঠানোর, সেগুলি পাঠানো হয়েছে। যেগুলি এখানে ব্যবস্থা নেওয়ার, সেগুলি এখানেই নেওয়া হচ্ছে।” কোনও সিদ্ধান্ত নিতে অযথা দেরি হয়নি বলেও দাবি তাঁর। কমিশন সূত্রের খবর, জুৎসি ফেরার পরই নির্বাচনী বিধিভঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে জেলাশাসকদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন সিইও। কমিশন সূত্রের খবর, দিল্লি যে এ রাজ্যের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপরে কড়া নজর রাখছে, তা-ও জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের মনে করিয়ে দেন সিইও।

বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, জুৎসি কলকাতায় না এলে সিইও এবং তাঁর দফতর হঠাৎ করে এতটা সক্রিয় হতো কি? তাঁদের অভিযোগ, এর আগে সিইও-র দফতরের কোনও হেলদোল নজরে পড়েনি। তাই সিইও-র নামে অভিযোগ করতে হয়েছে। সিপিএম নেতা রবীন দেবের কথায়, “আমরা অনেক অভিযোগ করেছি। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি হচ্ছে। শাসক দলকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। এত দিন সবই দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ইদানীং কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু তা হাস্যকর।”

কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার অভিযোগ, সোমবার শাসক দলের কর্মীদের দাপটে তিনি সবংয়ের নোনা মাধবচকে সভা করতে পারেননি। ক্ষুব্ধ মানসবাবুর মন্তব্য, “এমন কমিশনের তা হলে থেকে কী লাভ!” দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় বলেন, “জানি না কী কারণে সিইও এত রক্ষণাত্মক হয়ে গিয়েছেন। তাঁর তো নির্বাচন কমিশনের সুরক্ষা রয়েছে। তা হলে এত ভয় কীসের!”

তৃণমূল কিন্তু আস্থা রাখছে সুনীলবাবুর উপরেই। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন ও তাদের কাজকর্মের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। কমিশন যখন যেমন নির্দেশিকা জারি করছে, আমরা সব মেনে চলছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE