Advertisement
E-Paper

টালির চাল থেকে রাতারাতি রাজপ্রাসাদে

এ যেন আলাদিনের চিরাগ পাওয়ার গল্প! মাত্র কয়েক বছরে টালির চালের বাড়ি বদলে গিয়েছিল রাজপ্রাসাদে। ভাঙাচোরা সাইকেলের বদলে বাড়ির গ্যারাজে আসতে শুরু করেছিল নিত্যনতুন গাড়ি। যে ছেলেটি বাড়ির সামনে এক চিলতে টেলিফোন বুথ চালিয়ে যৎসামান্য আয় করত, সে-ই পরে বার হতো বাউন্সার-পরিবৃত হয়ে। শিবনারায়ণ দাস।

দেবাশিস দাশ

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৬
ভোরের বার্তা খবরের কাগজের প্রথম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে অমিত মিত্র। পাশে রয়েছেন শিবনারায়ণ দাসও।  ফাইল চিত্র

ভোরের বার্তা খবরের কাগজের প্রথম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে অমিত মিত্র। পাশে রয়েছেন শিবনারায়ণ দাসও। ফাইল চিত্র

এ যেন আলাদিনের চিরাগ পাওয়ার গল্প!

মাত্র কয়েক বছরে টালির চালের বাড়ি বদলে গিয়েছিল রাজপ্রাসাদে। ভাঙাচোরা সাইকেলের বদলে বাড়ির গ্যারাজে আসতে শুরু করেছিল নিত্যনতুন গাড়ি। যে ছেলেটি বাড়ির সামনে এক চিলতে টেলিফোন বুথ চালিয়ে যৎসামান্য আয় করত, সে-ই পরে বার হতো বাউন্সার-পরিবৃত হয়ে।

শিবনারায়ণ দাস। সিবিআই যাঁকে সারদা-কাণ্ডের অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ অ্যাখ্যা দিয়েছে। যিনি নিজেই সিলিকন নামের অর্থলগ্নি সংস্থার মালিক।

গত শনিবার সাঁতরাগাছি থেকে সিবিআইয়ের হাতে পাড়ার ছেলে ‘শিবু’র ধরা পড়ার খবর পেয়ে খুব একটা চমকে ওঠেননি হাওড়ার ধাড়সার মনসাতলার বাসিন্দারা। রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া শিবনারায়ণের আয়ের উৎস নিয়ে বহু দিন ধরেই তাঁদের মনে প্রশ্ন উঠছিল। বছর খানেক আগে পাওনাদার ও ইডি-র তাড়া খেয়ে প্রাসাদোপম বাড়ি তালাবন্ধ করে সপরিবার গা ঢাকা দেন শিবনারায়ণ। তখনই সকলে জেনে গিয়েছিলেন সাদা পথে বড়লোক হননি তিনি।

সোমবার ধাড়সার মনসাতলার সেই বন্ধ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা সমর বাগচী বললেন, “ওরা এক সময় ঠিক মতো খেতে পেত না। আর কয়েক বছরের মধ্যে টালির চালের বাড়ি ভেঙে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলল!”

কী রয়েছে এই রাজপ্রাসাদে?

চারতলা খিলান দেওয়া বাড়ি। নীচে কয়েকটি দোকানঘর এবং দু’টি বড় গ্যারাজ। বাড়ির প্রতিটি তলায় একাধিক শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। মূল ফটকটি দীর্ঘদিন তালাবন্ধ। ভিতরের বার্মা-সেগুন কাঠের দরজা-জানলাও বন্ধ। ঢোকার উপায় নেই। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগে বাড়ি ঘিরে থাকতেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁরা এখন না থাকলেও বাড়ির চারদিকে লাগানো সাত-সাতটি সিসিটিভি ক্যামের। ওই নিরাপত্তা বলয় টপকে যে গুটিকয়েক মানুষ ওই সময়ে ওই প্রাসাদে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন, তাঁদের এক জন সোমবার বললেন, “বসার ঘর পর্যন্ত ঢুকেছিলাম। আসবাবপত্র দেখে হাঁ হয়ে যাই।”

শুধু রাজকীয় চালচলনই নয়, দান-খয়রাতি করেও এলাকার ক্লাবগুলোকে নিজের হাতে রাখতে কাপর্ণ্য করেননি শিবনারায়ণ। নিজেকে সমাজসেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এলাকার কয়েকটি ক্লাবকে অ্যাম্বুল্যান্স ও পুজোয় মোটা চাঁদা দিয়েছেন।

কী ভাবে এই দ্রুত উত্থান শিবনারায়ণ দাসের?

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সিলিকনের মালিক শিবনারায়ণ প্রথম জীবনে টেলিফোন বুথে বসার পাশাপাশি এলাকায় কয়েক জনকে নিয়ে জমি-বাড়ির দালালি শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে ২০০৫ সালে তিনি অন্য জেলায় একটি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাও খুলেছিলেন। অভিযোগ, সেখান থেকে কিছু টাকা আয় করে ওই সংস্থাটি বন্ধ করে বেপাত্তা হয়ে যান। কয়েক বছর পরে ফিরে এসে টাওয়ার ইনফোটেক নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টদের দলনেতা হয়ে কাজ শুরু করেন। অভিযোগ, ওই সময় আর একটি লগ্নি সংস্থার কর্ণধারের গাড়ির চালকের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের আলাপ হয় এবং ধীরে ধীরে তিনি সুদীপ্তর প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। তৈরি হয় ‘সারদা’। তার ডিরেক্টর পদে যোগ দেন শিবনারায়ণ।

সিবিআই সূত্রের খবর, সারদা থেকে বেরিয়ে পরে শিবনারায়ণ নিজেই সিলিকন নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থা খোলেন। এরই মধ্যে হাওড়ার এক আইনজীবী-তৃণমূল নেতার হাত ধরে তিনি তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা শুরু করেন। তদন্তকারীদের অভিযোগ, ওই আইনজীবী-তৃণমূল নেতার উদ্যোগেই হাওড়ারই এক মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে শিবনারায়ণের। এর মধ্যে একটি দৈনিক সংবাদপত্রও প্রকাশ করেন তিনি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ওই সংবাদপত্রে হাওড়ার ওই আইনজীবীকে গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং একটি দামী গাড়ি উপহার দেন শিবনারায়ণ। সিবিআইয়ের দাবি, তিনি রাজ্য প্রশাসনের এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, সংবাদপত্রের প্রথম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রাজ্যের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-সহ একাধিক তৃণমূল নেতা।


হাওড়ায় শিবনারায়ণ দাসের সেই বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র

সুদীপ্ত গ্রেফতার হওয়ায় পাশা উল্টে যায়। অর্থলগ্নি সংস্থা ও দৈনিক সংবাদপত্র বন্ধ করে শিবনারায়ণ ফেরার হয়ে যান। সিবিআই সূত্রের খবর, অভাবে পড়ে নিজের কয়েকটা গাড়ি সাঁতরাগাছি স্টেশন চত্বরে গোপনে ভাড়া খাটাচ্ছিলেন তিনি। শনিবার সেই ভাড়া দেওয়ার গাড়ির টাকা তুলতে আসার সময় তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই। অভিযোগ, হাওড়ার বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ তৃণমূল নেতা তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

শিবনারায়ণ দাসকে আশ্রয় দেওয়ার এই অভিযোগ সোমবার কার্যত মেনে নিয়েছেন রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী এবং হাওড়ার তৃণমূল নেতা অরূপ রায়। সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানের শেষে অরূপবাবু সাংবাদিকদের বলেন, “সিবিআই যখন বলেছে, তখন নিশ্চয়ই তার ভিত্তি রয়েছে। তবে অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। হলে দল উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। কোনও অপরাধমূলক কার্যকলাপ দল প্রশ্রয় দেবে না।”

অরূপবাবুর বিরুদ্ধেও শিবনারায়ণের খবরের কাগজের অনুষ্ঠানে হাজির থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে তিনি জানান, তৃণমূল নেতা নির্মলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধেই তিনি পাঁচতারা হোটেলের ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তাঁর দাবি, “নির্মলেন্দুবাবু ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না, জানতাম না।”

বিজেপি এ-ও দাবি করেছে যে, শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে রাজ্যের অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রেরও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ সোমবার বলেন, “দিদির ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে, অর্থ ও শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে এখন শিবনারায়ণ দাসের ছবি বেরোচ্ছে! আগে ভাবতাম তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতারা সারদা-কাণ্ডে জড়িত। এখন দেখছি, অরাজনৈতিক জগৎ থেকে আসা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও নিবিড় ঘনিষ্ঠতা শিবনারায়ণের! সারদার অর্থ আর রাজ্যের অর্থ এক হয়ে গিয়েছে!”

অমিত মিত্রকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তাঁর কোনও মন্তব্য করার নেই।

saradha scam silicon shibnarayan das debasish das cbi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy