সারদার পাল্টা। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সহারা-যোগের অভিযোগে ধর্নায় তৃণমূল সাংসদরা। তবে মুকুল রায় রইলেন পিছনের সারিতেই। সোমবার রমাকান্ত কুশওয়াহার ছবি।
মদন মিত্রর পর কে, শাসক দলের ঘরে-বাইরে এই জল্পনাটাই এখন পয়লা নম্বরে। এই আবহে সিবিআই সূত্রের খবর, তারা পরবর্তী নিশানা ঠিক করে ফেলেছে। তৃণমূলের শীর্ষ স্তরের এক সর্বভারতীয় নেতাকে তলব এবং তার পর প্রয়োজন হলে আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে দিল্লি থেকে প্রয়োজনীয় সবুজ সঙ্কেতও চলে এসেছে।
সিবিআই সূত্রের খবর, তৃণমূলের ওই নেতার বিরুদ্ধে তাঁদের কাছে ভূরি ভূরি তথ্য রয়েছে। রয়েছে সারদা থেকে টাকা নেওয়ার নথি এবং সুদীপ্তর সঙ্গে ফোনে কথা বলার কয়েকশো ‘কল রেকর্ড’। সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায় ছাড়াও এই সব তথ্য ইতিমধ্যেই যাচাই করা হয়েছে ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষ, প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারের সঙ্গে। প্রাক্তন তৃণমূলী আসিফ খানও এ নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। এখন মদনবাবুর সঙ্গেও গোয়েন্দারা ওই সব তথ্য যাচাই করে নিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে।
সিবিআই অফিসারদের একাংশ জানাচ্ছেন, শনিবার রাতে আদালত থেকে ফেরার পরে মদনবাবুর সামনে আনা হয় এমনই কিছু নথি। তদন্তকারীদের বক্তব্য, সিবিআই যে এর মধ্যেই এত কিছু পেয়ে গিয়েছে, দৃশ্যত তা ভাবতে পারেননি মদনবাবু। প্রথমে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলেও একের পর এক তথ্যের ধাক্কায় তাঁর বাঁধ ভেঙে যায়। তখন তিনি ওই নেতা ও তাঁর আরও কয়েক জন সহকর্মী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উগরে দিতে থাকেন। তাঁর বক্তব্য ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে। তদন্তকারীরা তা দিল্লির সদর দফতরেও জানিয়েছেন। অভিযুক্ত নেতাকে এখনই ডাকা হবে কি না, তা-ও জানতে চান তদন্তকারীরা। সোমবার এ নিয়ে দিল্লির কর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়। সিবিআই সূত্রের খবর, বেলা ২টো নাগাদ দিল্লি সবুজ সঙ্কেত দেয়। এর পরে তদন্তকারীরা আলোচনায় বসেন আইনজীবীদের সঙ্গে। তাঁরা তদন্তকারীদের জানান, মদনবাবুকে জেরার বিষয়টি আরও একটু গুটিয়ে এনে তবে ওই নেতাকে ডাকা কৌশলগত ভাবে ঠিক হবে। স্থির হয়, কিছু দিনের মধ্যেই ওই নেতাকে আইন মোতাবেক চিঠি পাঠানো হবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রকে সামনে আনতেই তদন্ত করছে সিবিআই। মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পরে এ রাজ্যে একে একে গ্রেফতার হন ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত ওরফে নীতু সরকার, ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবাল, প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার এবং তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। জেরা করা হয় প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা বহু লোকজনকে। সর্বোপরি গত শুক্রবার গ্রেফতার হয়ে যান রাজ্যের ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। সিবিআই সূত্রের খবর, গোয়েন্দারা ঠিক করেই নিয়েছিলেন, তাঁরা ধাপে ধাপে এগোবেন। কান টানলে মাথা আসবে। মদন মিত্রের গ্রেফতারে সেই মাথা টানার পর্ব শুরু হয়েছে বলেই খবর। ক’দিন আগেই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ নিজে কলকাতার জনসভায় ‘মদন ভাগ, মুকুল ভাগ, মমতা ভাগ’ বলে স্লোগান তুলে গিয়েছিলেন। প্রায় একই হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছিল আসিফের মুখেও। মদন গ্রেফতার হওয়াতে এ বার কার পালা, সেই প্রশ্নটা তাই ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল।
সারদা কেলেঙ্কারির নেপথ্যে যে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জড়িয়ে রয়েছেন, সেই অভিযোগ প্রথম থেকেই ছিল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সিবিআই-কে লেখা সুদীপ্ত সেনের চিঠিতেও বহু নাম ছিল। কিন্তু রাজ্য পুলিশ মূল চক্রী হিসেবে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং সাংবাদিক-সাংসদ কুণাল ঘোষকেই শুধু গ্রেফতার করে। কিন্তু আসল মাথারা যে দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন, সেই অভিযোগ বারবার তুলছিলেন কুণাল। একই নালিশ এনেছিলেন তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে আসা নেতা আসিফ খানও। সমান্তরাল ভাবে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট) এবং এসএফআইও-র (সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস) রিপোর্টেও বড় মাথাদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত মিলছে বলে খবর।
সিবিআই আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, তাঁরা আর বেশি দেরি করতে রাজি নন। সিবিআইয়ের নতুন অধিকর্তা অনিল সিংহও তা-ই চান। সুপ্রিম কোর্ট যে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ উদ্ঘাটনের দায়িত্ব দিয়েছে সিবিআই-কে, ওই নেতাকে তলব করা ছাড়া তা সম্ভব নয় বলেই তদন্তকারীদের দাবি।
মদনবাবুকে এখন যেমন ওই নেতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, সোমবার মদনবাবুর কাছে তাঁর সম্পত্তির হিসেবও জানতে চান তদন্তকারীরা। মদনবাবুর জবাবের সূত্র ধরেই এ দিন দুপুরে তাঁর বড় ছেলে স্বরূপ মিত্রকে সিবিআই দফতরে ডেকে পাঠানো হয়। সিবিআই সূত্রের দাবি, এ বছর মার্চ মাসে স্বরূপের বিয়ের সময়ে কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল। ওই টাকার উৎস কী তা স্বরূপের কাছে জানতে চাওয়া হয়। পরে মদনবাবুর মুখোমুখি বসিয়েও জেরা করা হয় স্বরূপকে। দু’ঘণ্টা পরে তাঁকে ছেড়ে দেয় সিবিআই। স্বরূপের অবশ্য দাবি, সিবিআইয়ের ডাকে নয়, বাবার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি এসেছিলেন। কিন্তু তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
মদনকে এ দিন সিজিও কমপ্লেক্সে আনা হয়েছিল একেবারে সকাল সাড়ে ৬টাতেই। সাড়ে ৭টা নাগাদ তাঁকে চা-বিস্কুট দেওয়ার পরেই জেরা শুরু করেন তদন্তকারীরা। টানা তিন ঘণ্টা জেরার পরে তাঁকে সকালের খাবার দেওয়া হয়। বিকেলে মদনবাবুর আইনজীবী আসার পরে তাঁর সামনে বসিয়েও একপ্রস্ত জেরা করা হয়। মদনের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত আরও গতি পাচ্ছে বলে সিবিআইয়ের খবর। আর সেটাই চিন্তার বড় কারণ বলে মানছেন দলের নেতারাও।
বস্তুত সিবিআই যত ষড়যন্ত্রের উৎসমুখের দিকে এগোচ্ছে, শাসক দলের অস্বস্তি তত বাড়ছে। সৃঞ্জয় গ্রেফতার হওয়ার পরেই চক্রান্তের অভিযোগ তুলে সুর চড়িয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পথে নামিয়েছিলেন সেলিব্রিটিদের। সংসদে কখনও কালো কাপড়, কখনও লাল ডায়েরি দেখিয়ে প্রতিবাদে নেমেছিলেন সাংসদরা। কিন্তু দলীয় সূত্রেই খবর, মদন ধরা পড়ার পরে আতঙ্ক একেবারে শাসক দলের হেঁসেলে ঢুকে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মরিয়া হয়ে তাই প্রতিবাদের ভরকেন্দ্র দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন। এ দিন তাঁর নির্দেশ পালন করেছেন দলীয় সাংসদরা। দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় গত কিছু দিন যাবৎ প্রকাশ্যে আসছিলেন না। এ দিন তিনি প্রতিবাদে সামিল হলেও সামনের সারিতে থাকেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy