পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল শিবিরে ভাঙন ধরিয়ে ক্রমশই প্রধান বিরোধী হিসেবে উঠে আসছে বিজেপি। উল্টো দিকে তাঁদের দল যে ক্রমশই বিরোধী পরিসরটি হারিয়ে ফেলছে, আগামিকাল হায়দরাবাদে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু হওয়ার আগে তা প্রায় একবাক্যে স্বীকার করছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। এমনকী এ-ও মেনে নিচ্ছেন, এই অবস্থায় দলের ‘মুখ বদল’ হলে হয়তো কিছুটা চাঙ্গা করা যেত কর্মী-সমর্থকদের। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক পদে তৃতীয় তথা অন্তিম দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার মুখেও প্রকাশ কারাট যে দলের রশি ছাড়তে খুব একটা আগ্রহী, এমন কোনও ইঙ্গিত এখনও মিলছে না।
একান্তে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কিছু সদস্য আজ এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, দিল্লিতে ও রাজ্যে দলের সর্বোচ্চ স্তরে নেতৃত্ব বদল ছাড়া গতি নেই। এঁদের মতে, সারা দেশে সিপিএমের শোচনীয় পরিস্থিতির দায় নিয়ে কারাটের এখনই সরে দাঁড়ানো উচিত। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক পদ থেকে বিমান বসুও বরং সরে দাঁড়ান। তার পর নবীন নেতৃত্বের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হোক। এক মাত্র সে ক্ষেত্রেই নিচু তলার ক্যাডার এবং সমর্থকদের চাঙ্গা করা সম্ভব।
আসলে সমর্থকদের সেই মনোবল ও শরীরী ভাষাটাই উধাও। সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “দলের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য এখনও পশ্চিমবঙ্গ। ত্রিপুরায় দু’টি লোকসভা আসন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি। এই অবস্থায় মমতার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুযোগ হেলায় হারাচ্ছে আমাদের দল।” ওই নেতার ক্ষোভ, তৃণমূল সরকার যখন সিপিএম-কে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে জনসভার অনুমতি দেয়নি, তখন দল সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েও শেষ পর্যন্ত করেনি। কিন্তু রাজ্য বিজেপি মামলা করে হাইকোর্টের ইতিবাচক রায় আদায় করে অমিত শাহকে নিয়ে জনসভা করেই ছেড়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধি হিসেবে সিদ্ধার্থনারায়ণ সিংহও রাজ্য বিজেপিকে পূর্ণ মদত দিচ্ছেন। অথচ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক ব্যস্ত জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসের দলিলের কৌশলগত ত্রুটি-বিচ্যুতি পর্যালোচনা নিয়ে! বারাক ওবামা আসার আগে সিপিএমে আলোচনা হচ্ছে, কী ভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব।
বিমানবাবু ইতিমধ্যেই দলকে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি রাজ্য সম্পাদকের পদ ছাড়তে প্রস্তুত। ওই পদে সূর্যকান্ত মিশ্রকে আনা নিয়ে দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও শুরু হয়েছে। এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেসে এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কারাট কিন্তু দলের অধঃপতনের দায়িত্ব নিয়ে ইস্তফা দেওয়ার কথা মোটেই ভাবছেন না। দলের অন্দরের খবর, তিনি হয় চাইবেন নিজের ঘনিষ্ঠ এস আর পিল্লাইকে সম্পাদক পদে বসিয়ে বকলমে নিজে দল চালাতে। অথবা তাঁর শিবির দাবি তুলতে পারে, জরুরি ভিত্তিতে কারাটের মেয়াদ আর এক দফা বাড়ানো হোক। অথচ ঘটনা হল, কেন্দ্রীয় কমিটির বহু সদস্যই কারাটকে সরানোর পক্ষে। পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা তো ঘোর বিরোধী। কিন্তু পরবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কায় অনেকেই হায়দরাবাদে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চান না।
এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হচ্ছে দু’টি খসড়া নথি নিয়ে। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি কৌশলগত। রাজনৈতিক প্রস্তাবে বাম ঐক্য, অ-কংগ্রেসি অ-বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প গঠনের লক্ষ্যে সিপিএমের স্বাধীন ভাবে চলার কথা বলা হয়েছে। আর কৌশলগত বা সাংগঠনিক যে দলিলটি, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির আগের বৈঠকগুলিতে প্রবল বিতর্কের পর সীতারাম ইয়েচুরির পাল্টা প্রস্তাবগুলি প্রায় সবই গৃহীত হয়েছিল। কারাট আওয়াজ তুলেছিলেন যে, জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসের দলিলে বলা হয়েছিল, দীর্ঘমেয়াদি শ্রেণি সংগ্রামের পাশাপাশি ‘বুর্জোয়া ভূস্বামী’ রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে কৌশলগত ভাবে কাজে লাগাতে হবে। এটা করতে গিয়ে বহু দলের সঙ্গে সিপিএম আপস করেছে।
কিন্তু ইয়েচুরির বক্তব্য, জালন্ধরের কৌশল ভুল ছিল না। ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন, ১৯৮৯ সালে ভিপি সিংহের নেতৃত্বে অ-কংগ্রেসি সরকার গঠন থেকে ২০০৪-এ ইউপিএ সরকার তৈরি সবই এই জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসের সাফল্য। শুধু তা-ই নয়, কারাট দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে পর্যন্ত সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সিপিএমের প্রভাব ছিল অনেকটাই। ২০০৪-এর লোকসভা ভোটে দলের টিকিটে জিতে ৪৩ জন সাংসদ হন। কিন্তু কারাটের হাতে পড়ে দশ বছরেই সর্বভারতীয় প্রভাব খুইয়ে সেই সংখ্যাটা এখন নেমে দাঁড়িয়েছে ১০-এর কোঠায়! আজ কেন কারাট সে সবের দায় নেবেন না, সে প্রশ্নও উঠছে। ইয়েচুরির পাল্টা দলিলের পর অন্ধ্রের পলিটব্যুরো সদস্য রাঘবলু একটি তৃতীয় খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। চূড়ান্ত খসড়ায় ইয়েচুরির দলিল অনুসরণ করে সাংগঠনিক ব্যর্থতার কথা মেনে নেওয়া হয়েছে। জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসের লাইন ভুল, এমন কথাও বলা হয়নি। এবং প্রথমে প্লেনাম ডাকতে নারাজ কারাট এখন রাজি! পার্টি কংগ্রেসের পরে সেই প্লেনাম হবে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, বিপক্ষের (অর্থাৎ ইয়েচুরি-শিবিরের) যুক্তি-তর্ক সব মেনে নিয়েও কেন জালন্ধরের কৌশল নিয়ে কথা হবে হায়দরাবাদের মঞ্চে? দলেরই অনেকের সন্দেহ, আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক এবং এপ্রিলে বিশাখাপত্তনমের পার্টি কংগ্রেসে আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করার থেকেও কারাট শিবির বেশি তৎপর হবে বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের গদি বাঁচাতে! কারাট-নিজেও গদি আঁকড়ে থাকতে তৎপর। এবং এ সব করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রণকৌশল তৈরির ব্যাপারে হয়তো সে ভাবে কথা বলারই ফুরসত মিলবে না পার্টি কংগ্রেসে! ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগের বছরে তা যে বিজেপির পক্ষেই স্বস্তিদায়ক, সে বিষয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy