Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
নবান্ন দেখিয়ে প্রতারণা

নামে সারদা-সুদীপ্তের দোসর, কাজে প্রায় শোভরাজ

দু’জনেই সুদীপ্ত। সুদীপ্ত সেন এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। নাম-সাদৃশ্যে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছু হয়তো নেই। বিস্ময় যা কিছু তাঁদের নাম-মাহাত্ম্যে! কাজের অদ্ভুত মিলে!! বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থা খুলে সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা হিসেবে সেন সুদীপ্ত বেশ কিছু কাল ধরেই শিরোনাম দখল করে আছেন। কম যাচ্ছেন না চট্টোপাধ্যায় সুদীপ্তও। অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম ও ছবি লাগানো জাল ওয়েবসাইট তৈরি করে ঋণ দেওয়ার ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি।

প্রতারণার অভিযোগে ধৃত সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। চাতুর্যে চার্লস শোভরাজের (ইনসেটে) সঙ্গে তাঁর তুলনা দিচ্ছেন তদন্তকারীরাই।—নিজস্ব চিত্র।

প্রতারণার অভিযোগে ধৃত সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। চাতুর্যে চার্লস শোভরাজের (ইনসেটে) সঙ্গে তাঁর তুলনা দিচ্ছেন তদন্তকারীরাই।—নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৩
Share: Save:

দু’জনেই সুদীপ্ত। সুদীপ্ত সেন এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। নাম-সাদৃশ্যে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছু হয়তো নেই। বিস্ময় যা কিছু তাঁদের নাম-মাহাত্ম্যে! কাজের অদ্ভুত মিলে!!

বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থা খুলে সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা হিসেবে সেন সুদীপ্ত বেশ কিছু কাল ধরেই শিরোনাম দখল করে আছেন।

কম যাচ্ছেন না চট্টোপাধ্যায় সুদীপ্তও। অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম ও ছবি লাগানো জাল ওয়েবসাইট তৈরি করে ঋণ দেওয়ার ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি। আর এই কাজ করে অন্তত ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হাওড়ার ঠাকুর রামকৃষ্ণ লেনের সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়।

সেন সুদীপ্তের লগ্নি কেলেঙ্কারিতে অর্থের পরিমাণ হয়তো অনেক বেশি। তাঁর দোসরের কৃতিত্ব অন্য জায়গায়। তদন্তকারীদের মতে, অর্থ আত্মসাতের কৌশলগত অভিনবত্বে সেন সুদীপ্তকে টেক্কা দিয়েছেন চট্টোপাধ্যায় সুদীপ্ত। তাঁর প্রতারণার নয়া কৌশল রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের দুঁদে অফিসারদেরও। এতটাই যে, সেন সুদীপ্তকে টপকে সরাসরি শোভরাজের সঙ্গে চট্টোপাধ্যায় সুদীপ্তের তুলনা টানছেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, ছোট পরিসরে হলেও চার্লস শোভরাজের মতোই পাকা মগজের জালিয়াত সুদীপ্ত। তদন্তকারীদের ধারণা, এই জালিয়াতির জাল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এর পিছনে আরও অনেক বড় চক্রও থাকতে পারে।

সেন সুদীপ্তের কর্মকাণ্ডে শাসক দলের অনেক নেতা-মন্ত্রীর যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। আর চট্টোপাধ্যায় সুদীপ্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করতেন রাজ্য প্রশাসনের নতুন সদর নবান্নের ভবনটিকেই। তদন্তকারীরা জানান, ছক কষেই নবান্নের কাছে ১০০ বর্গফুটের এক চিলতে ঘর নিয়েছিলেন সুদীপ্ত। এবং সেই ঘরেই চলছিল জালিয়াতি। চক্রের ‘মাস্টার-মাইন্ড’ বা মূল পাণ্ডা সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়কে ১৬ জানুয়ারি, শুক্রবার গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি। বৃহস্পতিবার ফের তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন তদন্তকারীরা। গত ৪৮ ঘণ্টায় হাওড়া-কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে ৭০টি মোবাইল, ঋণের কয়েক হাজার আবেদনপত্র, শতাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথিপত্র, প্রচুর এটিএম কার্ড এবং আরও অনেক তথ্য পেয়েছেন দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের তদন্তকারীরা। সেই সব তথ্যপ্রমাণ ও নথিপত্র নিয়ে শুক্রবার দিল্লি ফিরে গিয়েছেন তাঁরা।

জালিয়াতির জন্য কেমন ফাঁদ পেতেছিলেন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়?

তদন্তকারীরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর নাম ও ছবি-সহ ‘প্রধানমন্ত্রী আদর্শ যোজনা’ নাম দিয়ে একটি ওয়েবসাইট খুলেছিলেন সুদীপ্ত। ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছিল, এই যোজনায় এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। ঋণের জন্য আবেদন করতে বলা হয় ওই ওয়েবসাইটেই। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঋণের আবেদন করলে ‘সিকিওরিটি ডিপোজিট’ হিসেবে এক লক্ষ টাকা জমা রাখতে বলা হত। একই সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হত আবেদনকারীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি, এটিএম কার্ড, এমনকী মোবাইল ফোনও। বলা হত, ঋণ পাওয়ার আগে ‘সিকিওরিটি’ হিসেবে এগুলো জমা রাখতে হবে। ঋণের আশায় প্রার্থীরা সেগুলো জমা দিতেন। আর টাকা এবং নথি-সহ সব কিছু গায়েব করে দিত ওই চক্র।

সুদীপ্ত এই প্রতারণায় রাজ্য সরকারের সদর কার্যালয় নবান্নকেও ব্যবহার করেছেন বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। কী ভাবে?

তদন্তকারীরা জানান, কেউ আবেদন করলে তাঁর বিশ্বাস অর্জন করার জন্য সিকিওরিটি ডিপোজিটের চেক এবং নানান নথিপত্র নিয়ে আসতে বলা হত নবান্নের চত্বরে। আবেদনকারী নবান্নের সামনে আসার পরে তাঁকে কোনও একটি জায়গায় অপেক্ষা করতে বলা হত। তার পরে সুদীপ্তের শাগরেদরা নিজেদের শরীরী ভাষায় এমন ভাব ফুটিয়ে তুলতেন, যেন তাঁরা নবান্নের উপর তলা থেকে নেমে এসে ওই সব নথিপত্র এবং চেক নিয়ে কাজের তাগিদে ফের নবান্নেই ঢুকে যাচ্ছেন! নিরাপত্তারক্ষীদের কড়াকড়ির জন্য যে আবেদনকারীকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তা-ও বুঝিয়ে দিতেন সুদীপ্ত-সঙ্গীরা।

প্রায় দু’বছর ধরে এই জালিয়াতি চলার পরে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অভিযোগ পায় দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের সাইবার ক্রাইম শাখা। তদন্তে নেমে তারা জানতে পারে, এই প্রতারণার মূল চক্রী সুদীপ্তের বাড়ি হাওড়ায়। ১৬ জানুয়ারি নবান্নের কাছেই শরৎ চ্যাটার্জি রোডের একটি বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করেন দিল্লির তদন্তকারীরা। হাওড়ার ঠাকুর রামকৃষ্ণ লেনের বাসিন্দা সুদীপ্তকে জেরা করে ধরা হয় হাওড়ারই বাসিন্দা স্নেহাংশু জানাকে। দু’জনকেই ট্রানজিট রিমান্ডে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রাথমিক তদন্তে দিল্লি পুলিশ জানতে পারে, ওই চক্রের জাল দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। জাল ওয়েবসাইট খুলে সরকারি ঋণ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ তুলে নিয়েছে প্রতারকেরা। তদন্তকারীদের ধারণা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েক হাজার মানুষের কাছ থেকে কয়েকশো কোটি টাকা হাতিয়েছে ওই প্রতারক চক্র।

কে এই সুদীপ্ত?

হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রের খবর, মধ্য হাওড়ার বাসিন্দা বছর পঁয়ত্রিশের সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞানের স্নাতক। তাঁর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসার ছিলেন। ভাই চাকরি সূত্রে বিদেশে থাকেন। ধৃতের স্ত্রী ও দু’বছরের একটি সন্তান আছে। পুলিশ জানায়, প্রতারণায় সুদীপ্তের হাতে-খড়ি বছর পনেরো আগে। জালিয়াতির সূচনা পর্বে মাত্র ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে মারুতি গাড়ি দেবেন বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলেছিলেন তিনি। অনেকটা সেন সুদীপ্তের অবৈধ লগ্নির ব্যবসায় বিনিয়োগ করা টাকার বহু গুণ অতি দ্রুত ফেরত দেওয়ার আশ্বাসের মতো। সে-যাত্রায় প্রার্থীদের টাকা ফেরত দিয়ে চট্টোপাধ্যায় সুদীপ্তকে বাঁচিয়ে দেয় তাঁর পরিবার।

কিন্তু নিজেকে শুধরে নিতে পারেননি সুদীপ্ত। তদন্তকারীরা জানান, সুদীপ্ত কখনও সরকারি অফিসার, কখনও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসার বলে গ্রাহকদের কাছে নিজের পরিচয় দিলেও পারত পক্ষে তাঁদের সামনে যেতেন না। তাঁর শাগরেদরাই আবেদনকারীদের কাছ থেকে চেক এবং নথিপত্র সংগ্রহ করতেন। তাই প্রতারিতদের অনেকে সুদীপ্তকে কখনও সামনাসামনি দেখেননি বলেই তদন্তকারীদের জানিয়েছেন।

চার্লস শোভরাজ দুষ্কর্ম চালাতেন দুনিয়ে জুড়ে। বাংলার খুদে শোভরাজ সুদীপ্তের প্রতারণার জাল কত দূর ছড়ানো, দেখছেন তদন্তকারীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

charles sobhraj sudipta chattopadhyay debasish dash
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE