Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নিস্পৃহতার চাদর, অপারগতার আগুন

চৈত্রশেষের সকাল সাড়ে আটটা, সিঁথির মোড়। এমনিতে যতখানি গরম, ভোটের হাওয়া তার চাইতেও বেশি গরম কি না, তারই আঁচ নিতে বেরিয়ে পড়েছি। দিন কয়েক ধরে বাড়িতে বসে কাগজ পড়ে আর চ্যানেল সার্ফ করে মনে হচ্ছিল, প্রতি বারের মতো এ বারও, যথারীতি, ওয়ার্ম আপ চলছে জোরকদমে। কিন্তু খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের বাইরেও একটা পৃথিবী আছে, কখনও-সখনও সেখানেও উঁকি মারাটা দরকার। তাই রোদের ধার ঘেঁষে বসা সকালের বাজার দেখে নেমে পড়লাম।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০৩
Share: Save:

চৈত্রশেষের সকাল সাড়ে আটটা, সিঁথির মোড়। এমনিতে যতখানি গরম, ভোটের হাওয়া তার চাইতেও বেশি গরম কি না, তারই আঁচ নিতে বেরিয়ে পড়েছি। দিন কয়েক ধরে বাড়িতে বসে কাগজ পড়ে আর চ্যানেল সার্ফ করে মনে হচ্ছিল, প্রতি বারের মতো এ বারও, যথারীতি, ওয়ার্ম আপ চলছে জোরকদমে। কিন্তু খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের বাইরেও একটা পৃথিবী আছে, কখনও-সখনও সেখানেও উঁকি মারাটা দরকার। তাই রোদের ধার ঘেঁষে বসা সকালের বাজার দেখে নেমে পড়লাম।

রোজকার ব্যস্ত দরদামের ফাঁকেও চা-দোকানে আড্ডা-তর্ক চলছে। ভেবেছিলাম ভোট নিয়েই নির্ঘাৎ, কিন্তু নিরাশ হতে হল। ফুটবল থেকে ফেংশুই সবই আছে, ভোট নেই। এ সবের মধ্যেই গোটা তিনেক খবরের কাগজ নিয়ে গুছিয়ে বসেছেন এক ভদ্রলোক, তাঁর পাশে বসেই লাল চা বলে দিলাম। দেখলাম, খুঁটিয়ে খবর পড়ছেন। এবং ভোটের খবরই। “আজ আবার নতুন কিছু হল নাকি?” একটু ভয়ে ভয়েই করলাম প্রশ্নটা। ভদ্রলোক দেখলাম উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। বললেন, “নতুন আর হবেটা কী? সবকিছু তো মেনেই নিয়েছি। এক টাকা দাম বাড়ুক আর পাঁচ টাকা, কারও মুখে কোনও কথা শুনেছেন? শুনবেন না। আগে ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোয় আগুন জ্বলে গেছল মশায়। সে-দিন আর নেই।”

ইনিংসটা এ রকম ভাবে শুরু হবে আশা করিনি। কাগজ আর টিভির দৌলতে আমার বেশ একটা ধারণা হয়েছিল, দিল্লির গদি দখল নিয়ে বাংলার মাটি যথেষ্ট তেতে উঠেছে, এক বার বাইরে পা রাখলেই আঁচে ঝলসে যাব। যদিও একখানা চাল টিপলেই ভাতের হাল বোঝা যাবে, নির্বাচনী হাঁড়ি অতটা ছোট নয়।

উত্তর কলকাতার আর এক প্রাচীন ও বিখ্যাত চায়ের ঠেকে পৌঁছলাম আরও একটু বেলার দিকে। দেদার লোকজন, ঘেমে জল হয়ে গিয়েও দিব্যি চা-টোস্ট খেয়ে যাচ্ছে। আলাপ হয়ে গেল এক মধ্যবয়স্কার সঙ্গে, কলকাতার একটি নামী স্কুলে ইংরেজি পড়ান তিনি। সটান বললেন, বহু দিন ভোট দেন না। কারণটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, অনেকদিনই প্রার্থীদের মধ্যে কোনও ভাল মানুষ খুঁজে পাননি তিনি। এ বছরও যেমন পাচ্ছেন না। ভাল নেতা হওয়ার প্রাথমিক শর্তই হল ভাল মানুষ হওয়া। এটাই তাঁর দাবি। “তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন কি সামনে? তবে হ্যাঁ, মোদী এলে ক্ষতিটা আরও বেশি হবে” নিজের মত এ ভাবেই জাহির করলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব শিক্ষিকা। আরও দু’চার জনের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ উৎসাহ বা উত্তাপ টের পেলাম না। কেমন একটা হচ্ছে-হবে ধরনের মনোভাব যেন। রাশিতত্ত্বের নিরিখে এটা কোনও স্যাম্পেল সাইজই নয়, তবু নিজেকেই জিগ্যেস করছিলাম বাংলার সাধারণ মানুষজন কি তা হলে রাজনীতি নিয়ে সত্যিই বীতশ্রদ্ধ এত দিনে? নাকি এই নিস্পৃহতার চাদরও আসলে এক ধরনের রাজনীতিই? যাঁরা ধারাবাহিক ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু তাঁদের বাইরেও রাজনীতি-সচেতন যে অসংখ্য মানুষজন, তাঁদের মনোযোগ কি একটু মিইয়ে গিয়েছে তা হলে? এক দিকে নিজেদের প্রতিই সব কিছু মেনে নেওয়ার অভিযোগ, অন্য দিকে রাজনীতিকদের প্রতি ঘোর অবিশ্বাস এই দুই দেওয়ালের মাঝের করিডরটুকুই কি তা হলে এখন সাধারণের রাজনৈতিক অবস্থান? এত সহজে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোটা ঠিক নয়। আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমি কে-ই বা? আমার, আমাদের মতো লোকের কাজ তো কেবল দেখা আর সেই দেখাকে ভাষায় অনুবাদের চেষ্টা করে যাওয়া। দুপুর গড়িয়ে রোদটা একটু পড়লে রওনা দিলাম ডায়মন্ড হারবারের দিকে। কলকাতার গা-লাগোয়া হলেও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেশ অন্য রকম একটা উপস্থিতি রয়েছে। পৌঁছতে বিকেল প্রায় পেরিয়ে গেল। জলের ধার দিয়ে বয়ে যাওয়া ফুটপাথে চা-মুড়ি-ফুচকার নিরিবিলি পসরা... বাঙালির মেরিন ড্রাইভ জুড়ে কোথাও আড্ডার জটলা, আবার কোথাও যুগলের আড়াল খোঁজা। ডায়মন্ড হারবার এতটুকুও পাল্টায়নি।

আপাতত পরিবর্তনের হাওয়া সেখানে টানটান, পুরসভায় কায়েম রয়েছে তৃণমূল। বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, আসন্ন ভোটে তৃণমূলের জিতে যাওয়া নিয়ে প্রায় কোনও সন্দেহ কারও মনেই নেই। কিন্তু যেটা আছে, সেটা হল গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও তার ফলাফল নিয়ে উৎসাহের চরম অভাব। কলকাতা নেহাত শহুরে বলে তার অহঙ্কারী নিরুত্তাপকে একটু হালকা ভাবেই নিচ্ছিলাম, কিন্তু শহরতলির এই নির্লিপ্তি আমাকে অবাক করে দিল। আমি নিজে বেশ কিছু বছর যাবৎ প্রহসন আর ভারতীয় রাজনীতির তফাত করার পিছনে সময় ব্যয় করব না বলেই মনস্থ করেছি, কিন্তু আমার দলে এত জন মানুষ আছেন সেটা একেবারেই আন্দাজ করতে পারিনি। হয়তো আমার মতো নৈরাশ্যবাদী হয়ে ওঠেননি কেউই, কিন্তু লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে দুর্দান্ত কিছু আশাও করছেন না এই মুহূর্তে।

যাঁর হাঁকে ঝালমুড়ি খেলাম, তিনি তো বলেই দিলেন, “ভোটের হাওয়া-ফাওয়া কিছু নেই দাদা, সব ঠান্ডা। চুপচাপ। কেউ আর এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না।” নিস্পৃহতার চাদরটা তা হলে এই এত দূর অবধি বিছিয়ে আছে? এমনকী বয়স্কদের সান্ধ্য জমায়েতেও রাজনীতি নিয়ে রা কাড়ছেন না কেউ। দিল্লি কি তা হলে সত্যিই দূর হয়ে গেল দেশের বাকি অংশ থেকে?

সন্ধে নেমে এসেছে, ফিরতে হবে এ বার। খুরিতে দিনের শেষ লাল চা নিয়ে জলের ধারের একটা দোকানে বসলাম। আমার পাশেই দু’টি কমবয়সী ছেলে। কী একটা প্রসঙ্গে এক জন ভোটের কথা তুলতেই অন্য জন ঝাঁঝিয়ে জবাব দিল, “রাখ তো তোর ভোট! এ দেশে কারও কোনও সম্মান আছে? নেতাদের কেউ ইজ্জত দেয়? শুধু ওই গদিটার জন্য সব, বুঝলি? ওটারই ওজন। একটা প্রচারসভায় কত খরচা হয় জানিস? দেশের মানুষ এ দিকে খেতে পাচ্ছে না।”

দূরে, জলের ও-পাশে ততক্ষণে টিমটিম করছে সারি সারি আলো। ওগুলো কি ট্রলারের আলো? বসতির? নাকি ক্ষমতার? এত দূর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। মেনে নেওয়ার মধ্যেও একটা অপারগতার আগুন থাকে, আলোগুলো সেটারও হতে পারে। আমার কেবল মনে হল কয়েকশো বছর আগেকার ভারতবর্ষের কথা। সে ও এক গদির ইতিহাস। ময়ূর সিংহাসনকে কেন্দ্র করে কত হানাহানি আর রক্তপাত ঘটে গিয়েছে... মোগল সাম্রাজ্যে সাধারণ মানুষের হাল ফিরেছিল কি? সেই রাজতন্ত্র থেকে সত্যিই কতখানি এগিয়ে ২০১৪-র প্রাক-নির্বাচনী গণতন্ত্র? উত্তরটা সন্ধের ঠান্ডা অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হল না।

ফেরার পথে সারি সারি বাস আর ট্রাকের পিছনে পড়তে হল, ক্লান্ত লাগছিল খুব। সারা দিনের এই ঘোরাঘুরির সঞ্চয় তবে কেবলই নিস্পৃহতা? হঠাৎ চোখ গেল সামনের বাসটার দিকে। পিছনে লেখা ‘সত্যমেব জয়তে’। তার কিছুটা নীচেই জ্বলজ্বল করছে সাবধানবাণী ‘দূরত্ব বজায় রাখুন’। আর এ-দুয়ের মাঝে পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে অপটু তুলিতে আঁকা একখানা ময়ূর। ভারতের জাতীয় পাখি। ভারতের সিংহাসনের ডাকনাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, বাসের পিছনের ওই দু’লাইন লেখা আর আঁকাটুকু আসলে ভারতবর্ষের ছোট, অথচ নিখুঁত সংস্করণ। যে ভারতবর্ষ নির্বাচনের, সাধারণের, আবহমানের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

srijato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE