Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রাথমিকে ধাক্কা পার্থর, সরলেন ১৪ চেয়ারম্যান

দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মাথায় ১৪টি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিলেন নতুন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই এঁদের নিয়োগ করা হয়েছিল। তিন বছরের মধ্যেই কেন চেয়ারম্যানদের সরানোর দরকার পড়ল, তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০২:৫০
Share: Save:

দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মাথায় ১৪টি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিলেন নতুন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই এঁদের নিয়োগ করা হয়েছিল। তিন বছরের মধ্যেই কেন চেয়ারম্যানদের সরানোর দরকার পড়ল, তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রী বোর্ডগুলি পুনর্গঠনের যুক্তি দিলেও তাঁর দফতরের কর্তাদের একাংশ এই সিদ্ধান্তের পিছনে গত বছরের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা (টেট) ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, পরীক্ষা পর্ব যথেষ্ট ‘দক্ষতার’ সঙ্গে সামাল দিতে না পারার ফলেই সরতে হল ওই চেয়ারম্যানদের।

প্রতিটি জেলায় প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে চেয়ারম্যান, জেলার বিধায়ক, জেলা পরিষদের সভাধিপতি ছাড়াও ছ’জন সরকারি প্রতিনিধি থাকেন। শুক্রবার চেয়ারম্যানদেরই শুধু সরানো হয়েছে। পরে সরকারি প্রতিনিধিদেরও বদলে দেওয়া হবে বলে শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর। স্কুলশিক্ষা দফতরের আর একটি সূত্র অবশ্য বলছে, অপসারিতদের কাউকে কাউকে পুনর্গঠিত বোর্ডে স্ব-পদে ফিরিয়ে আনা হতে পারে।

পাঁচটি জেলার (নদিয়া, দুই মেদিনীপুর, হুগলি এবং কলকাতা) সংসদের চেয়ারম্যানকে আপাতত সরানো হচ্ছে না। যাঁদের মধ্যে বাম আমল থেকেই কলকাতার চেয়ারম্যান পদে আসীন কার্তিক মান্না যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন পূর্ব মেদিনীপুরে শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী বলে পরিচিত গোপাল সাউ-ও। দফতর সূত্রের বক্তব্য, এই পাঁচটি জেলার চেয়ারম্যানদের হাতে এই মুহূর্তে কিছু সরকারি কাজের দায়িত্ব আছে। সে সব মিটলে এঁদেরও সরানো হতে পারে। সূত্রটি জানান, কোপ পড়তে পারে রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের উপরেও। ওই পদের জন্য যোগ্য লোকের সন্ধান চলছে।

শিক্ষামন্ত্রী এ দিন বলেন, “জেলা প্রাথমিক বোর্ডগুলিকে পুনর্গঠনের জন্যই চেয়ারম্যানদের সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। দু’চার দিনের মধ্যেই সেগুলি পুনর্গঠিত হবে। নতুন চেয়ারম্যানদের নামও ঘোষণা করা হবে।” অপসারিত চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ নির্দেশ হাতে পেয়েছেন। যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার মীনা ঘোষ। আবার বর্ধমানের দেবাশিস নাগ বা বীরভূমের রাজা ঘোষ এখনও কোনও নির্দেশ পাননি। পুরুলিয়ার চেয়ারম্যান নীলকমল মাহাতো বলেছেন, “নির্দেশ এখনও হাতে পাইনি, তবে শুনেছি খবরটা।” কী কারণে তাঁদের সরানো হচ্ছে, সেটা জানেন না বলেই অবশ্য অপসারিতদের দাবি।

তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে কলকাতা ছাড়া বামফ্রন্ট আমলের জেলা প্রাথমিক সংসদগুলির সব ক’টিকেই ভেঙে নতুন চেয়ারম্যান বসানো হয়েছিল। রাজ্য প্রাথমিক পর্ষদেও নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। তিন বছরের মধ্যেই আবার রদবদলের প্রয়োজন হল কেন? পার্থবাবুর জবাব, “সংসদগুলি যাতে ভাল কাজ করতে পারে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।” এত দিন কি জেলা বোর্ডগুলি ভাল কাজ করতে পারেনি? পার্থবাবু এ ব্যাপারে সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

শিক্ষা দফতরের একটি সূত্র অবশ্য দাবি করছেন, প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে প্রচুর বেনো জল ঢুকে গিয়েছিল বলে সরকারের একাংশের মত। দলের উপরতলার সুপারিশ এবং চাপে অনেক অযোগ্য লোক জেলা প্রাথমিক সংসদগুলির চেয়ারম্যান পদে বসেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেই বেনো জল সরানোর প্রক্রিয়াই এখন শুরু হয়েছে।

গত বছর টেট পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। মোটা টাকা নিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া এবং স্বজনপোষণের অভিযোগে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদগুলি সেই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না বলেই প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য। জেলায় জেলায় প্রাথমিক বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সরানোর পিছনে সেটা বড় কারণ বলে শিক্ষা দফতরের কর্তাদের অনেকেই মনে করছেন। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু যদিও এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “আমি এখন অন্য দফতরে। শিক্ষা দফতর নিয়ে কোনও কথাই বলব না।”

কিন্তু টাকার বিনিময়ে চাকরি তথা শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপোষণের মতো গুরুতর অভিযোগ যেখানে রয়েছে, সেখানে চেয়ারম্যান বদল করা মানে কি প্রকারান্তরে অভিযোগগুলির সত্যতা মেনে নেওয়া নয়? সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, “এত দিন দলতন্ত্র দেখেছি। এ বার তারও উপরে গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম হতে দেখছি। কে কার লোক, সেটাই এখন একমাত্র বিবেচ্য হয়ে উঠছে।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় অবশ্য দলীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগ নস্যাৎ করে বলেছেন, “এ সব ভিত্তিহীন কথাবার্তার কোনও মানে হয় না।” শিক্ষা দফতরের কর্তাব্যক্তিদের একাংশ অবশ্য আর একটি ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যে পরিবর্তনের পরে প্রাথমিক বোর্ডগুলিতে যে সব চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন, তাঁরা সরাসরি তৃণমূল ভবনের অনুমোদন নিয়েই পদে আসীন হয়েছিলেন। বেনো জলের প্রশ্ন এখানে অবান্তর। এই চেয়ারম্যানদের অনেকে জেলা স্তরের তৃণমূল নেতাদের নিকট-আত্মীয়, কেউ বা মন্ত্রিবর্গের কাছের লোক। যেমন, বীরভূম বোর্ডের চেয়ারম্যান রাজা ঘোষ জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের আত্মীয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার চেয়ারম্যান সুরঞ্জনা চক্রবর্তী এক মন্ত্রীর সহযোগীর স্ত্রী।

কিন্তু ঘটনা হল, গত বার টেট-এর সময়ে দেখা গিয়েছে, এঁদের সকলে সমান ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। যেমন সুরঞ্জনাদেবীর একটি অডিও টেপ সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গিয়েই টেট-দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। তার পরই জেলায় জেলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই জাতীয় ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না সরকার। এ বছর টেট পরীক্ষার আগেই তাই ‘দক্ষ’ চেয়ারম্যান নিয়োগে ব্রতী হয়েছেন পার্থবাবু।

শিক্ষা দফতরের কর্তাব্যক্তিদের একাংশের মতে, দলের মুখ না পুড়িয়েই দলের স্বার্থ দেখতে পারবেন এমন ‘দক্ষ’ লোক খোঁজার পর্ব এ বার শুরু হবে। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে পরামর্শ করেই পার্থবাবু এই নতুন নিয়োগ করবেন। বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও প্রশ্ন, “সরকার বদল হলে বড় বড় পদে বদল আসে। এখানে তো সরকার বদলায়নি। শিক্ষক নিয়োগে দলতন্ত্র আরও মজবুত করার জন্যই কি তবে এত রদবদলের প্রয়োজন হচ্ছে?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

primary education partha chattyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE