Advertisement
০২ মে ২০২৪

প্রবীণ প্রেমের গোধূলি রঙেই ধরণী যেন স্বপ্নের দেশ

বাবার অকালপ্রয়াণে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন মুম্বইপ্রবাসী মেয়ে। মা সবে পঞ্চাশের কোঠা ছাড়িয়েছেন। বাকি জীবনটা একা থাকবেন? তেড়েফুঁড়ে ইন্টারনেটে মায়ের বর খোঁজা শুরু হল। কেনিয়াপ্রবাসী ষাট ছুঁই ছুঁই এক বিপত্নীক ডাক্তারও নতুন করে জীবন শুরুর কথা ভাবছিলেন। ছেলেরা সূদূর আমেরিকায় থাকে। এক রাতে হাল্কা ‘স্ট্রোক’ হওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, কিছুতেই একা থাকবেন না।

সেলুলয়েডেও ধরা দিয়েছে দ্বিতীয় ইনিংস। ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ ছবির একটি দৃশ্যে ধর্মেন্দ্র ও নাফিসা আলি।

সেলুলয়েডেও ধরা দিয়েছে দ্বিতীয় ইনিংস। ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ ছবির একটি দৃশ্যে ধর্মেন্দ্র ও নাফিসা আলি।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৮
Share: Save:

বাবার অকালপ্রয়াণে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন মুম্বইপ্রবাসী মেয়ে। মা সবে পঞ্চাশের কোঠা ছাড়িয়েছেন। বাকি জীবনটা একা থাকবেন?

তেড়েফুঁড়ে ইন্টারনেটে মায়ের বর খোঁজা শুরু হল। কেনিয়াপ্রবাসী ষাট ছুঁই ছুঁই এক বিপত্নীক ডাক্তারও নতুন করে জীবন শুরুর কথা ভাবছিলেন। ছেলেরা সূদূর আমেরিকায় থাকে। এক রাতে হাল্কা ‘স্ট্রোক’ হওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, কিছুতেই একা থাকবেন না।

যোগাযোগ ঘটতেই চার হাত এক হতে দেরি হল না।

এই বিয়ের পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। কেনিয়ার পাট চুকিয়ে নবদম্পতি ফিরেও এসেছেন এ শহরে। দক্ষিণ কলকাতায় মহিলার প্রথম শ্বশুরবাড়িতেই ঘরকন্না করছেন দু’জনে। মেয়ের মুখে তৃপ্তির হাসি, “মায়ের বিয়ে দেওয়াটা বোধহয় আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।”

সিইএসসি-র অবসরপ্রাপ্ত কর্তার গল্পটা আবার ‘চিনি কম’ ধাঁচের। মধ্যষাটে পৌঁছে মনের মানুষটিকে বিয়ে করলেও তাঁর ছেলে বাবার এই সম্পর্ক মানতে নারাজ। দশ বছর আগে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে বছর পনেরোর ছোট এক বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বন্ধু-আত্মীয়দের মধ্যে ঢি-ঢি। কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা, “জীবনভর কারও প্রতি কতর্ব্যে ফাঁক রাখিনি। এ বার নিজের খুশিতে বাঁচতে চাই।”

প্রবীণ জুটিরা অনেকেই আজকাল এমন অকুতোভয়। আমির খানের টিভি শো-এ এসে নিজেদের কথা বলে গিয়েছেন পুণের জয়ন্ত জোশী ও লীনা জোশী। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে জয়ন্তের পূর্বতন স্ত্রী নিজেই স্বামীকে একা থাকতে বারণ করে গিয়েছিলেন। প্রবাসী পুত্রদেরও প্রশ্রয় ছিল। ফলে জয়ন্ত কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন, ৭৯ বছরের সুস্থ পাত্রের জন্য রঙিন ও জীবন্ত মনের পাত্রীর আর্জি জানিয়ে। এর পরেই জীবন রঙ্গমঞ্চে লীনার প্রবেশ। বর মরাঠিভাষী, বউয়ের ভাষা মালয়ালম! গোধূলির রঙেই এ ধরণী হঠাৎ স্বপ্নের দেশ।

এমন ছক-ভাঙা চিত্রনাট্যে অবাক নন বাধর্ক্যবিশারদ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী। জাতীয় বার্ধক্য নীতি গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারের কমিটির এই সদস্য বলছেন, “অনেকেই ইদানীং ষাট পেরিয়েও ২৫-৩০ বছর সুস্থ-সচল ভাবে বাঁচছেন। সুতরাং সাত তাড়াতাড়ি নটে গাছটি কেন মুড়োবে?” রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে, দুনিয়া জুড়েই ৮০ বছরের বেশি বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশেও জনসংখ্যার ২০ শতাংশই বয়স্কদের দলভুক্ত হবেন।

ইন্দ্রাণীর ব্যাখ্যা, এই দীর্ঘ জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিঃসঙ্গতা ঢাকতে কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় সচল-সরব! কেউ নতুন করে পড়াশোনা, ছবি বা গান শিখে কম বয়সের শখ মেটাচ্ছেন। সঙ্গী বা সঙ্গিনী খোঁজার তাগিদটাও একাকীত্বের বিরুদ্ধে লড়াই। এটা মাথায় রেখেই দেশময় ঘুরে অভিনব ঘটকালির ব্রতে সামিল হয়েছেন আমদাবাদের এক প্রবীণ। অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মচারী নাথুভাই পটেল ভুজের ভূমিকম্প দেখেছিলেন। ভাঙাচোরা অজস্র পরিবারকে দেখেই প্রবীণদের সংসার জোড়া দেওয়ার ভাবনাটা তাঁর মগজে ঢুকে পড়ে। গত এক দশকে গুজরাত-সহ দেশের শহরে-শহরে ঘুরে বুড়োবুড়িদের মেলানোর কাজ করে চলেছেন। মুম্বই, বেঙ্গালুরু, পুণে, হায়দরবাদ, ভোপাল, জয়পুরের পরে এ বার কলকাতা। আগামী ২১ ডিসেম্বর চেতলাহাট রোডের মহেশ্বরী বিকাশ ভবনে নাথুভাই আয়োজিত বয়স্কদের জীবনসাথী সম্মেলন।

এ পর্যন্ত ৭০টি দম্পতিকে বিয়ের চৌকাঠ পার করিয়েছেন প্রবীণ গুজরাতি। আর ১৬ জন একসঙ্গে বসবাস করছেন। সুপ্রিম কোর্টের একটি সাম্প্রতিক রায় অনুযায়ী, বিয়ে না-করে এক সঙ্গে থাকাটাও যে কোনও দম্পতির ব্যক্তিগত অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। নাথুভাই বলছেন, “বুড়ো বয়সে পারস্পরিক সাহচর্যটাই যথেষ্ট। কাগজে-কলমে বিয়েয় কি এল-গেল!”

হায়দরাবাদবাসী ৬৫ বছরের ‘তরুণী’ রাজেশ্বরীও তা-ই মনে করেন। ৩০ বছর বয়সে বিবাহবিচ্ছেদের পরে স্কুলমাস্টারি করে তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন। নিজেকে নিয়ে ভাববার অবকাশই মেলেনি। কয়েক বছর হল, একলা বুড়োবুড়িদের সঙ্গী খুঁজে দিতে তিনিও একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন।

বছর তিনেক আগে নিজের জীবনসঙ্গী, ৬৭ বছরের দামোদরকেও খুঁজে পেয়েছেন রাজেশ্বরী। কিন্তু বিয়ে করেননি। কেন? রাজেশ্বরীর কথায়, “আমি যে একলা মানুষদের নিয়ে কাজ করি, তাঁদের অনেকেই নানা অসুবিধেয় বিয়ে করে উঠতে পারেন না। ওঁদের মনের জোর দিতে তাই আমরাও লিভ-ইন করছি।” তবে একটা ব্যাপারে রাজেশ্বরী-নাথুভাই দু’জনেই কট্টর। নিখরচার জীবনসাথী সম্মেলনে সচিত্র পরিচয়পত্র, স্বামী বা স্ত্রীবিয়োগ কিংবা বিবাহবিচ্ছেদের নথি সঙ্গে রাখা চাই। কারণ, কেউ কেউ পরিচয় ভাঁড়িয়েও এই আসরে ঢুকে পড়তে পারেন।

বুড়োবুড়িদের এই দ্বিতীয় ইনিংসকে দু’হাত তুলে সমর্থন করছেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। “সংসার গড়ার কোনও বয়স নেই। দু’জনে মিলে ‘শেয়ার’ করার মধ্যেই জীবনটা রঙিন হয়ে ওঠে।” তবে সব সম্পর্কই যে মসৃণ হয় তা-ও নয়। নাথুভাই-রাজেশ্বরীদের অভিজ্ঞতায় বুড়োবুড়িদের দু’-তিনটি বিয়ে ভাঙার কিস্সাও আছে। আগের বিয়ের সন্তানদের সম্পত্তি ভাগের জটিলতার জেরেও বিয়ে ভেঙেছে।

“বুড়ো বয়সে অহেতুক জটিলতাও কিন্তু কাম্য নয়,” বলছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। চিরকেলে সংস্কার, আত্মীয়দের চাপ বা নানা ধরনের জড়তা কাটিয়ে প্রবীণ বয়সে যৌথ জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যে সোজা কাজ নয়, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবু মোটের উপর তাঁর ভোটও পাচ্ছেন এই প্রবীণ প্রেমিক-প্রেমিকারা। “নানা ভাবেই বুড়ো বয়সের একাকীত্বের ওষুধ খোঁজা চলছে। সে-দিক দিয়ে দেখলে প্রবীণদের সম্পর্ক গড়ে তোলাতে আমার আপত্তি নেই।” মাঝসত্তরে পৌঁছে গাঁটছড়া বাঁধা লীনা জোশীর অভিজ্ঞতা “বুড়ো বয়সের বিয়েতেও খিটিমিটি থাকে। সব মিলিয়েই সংসার জমে ওঠে।”

সূর্য ডোবার ডাক তাই অবান্তর! কারও কারও চোখে অস্তরাগেই আকাশটা সব থেকে সুন্দর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

old age marriage riju basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE