Advertisement
১৯ মে ২০২৪

বিজেপি-তে ঢল, আস্থা মুস্তাকে

যে নেতার হাত ধরে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিপুল সাফল্য দেখেছিল দল, হঠাত্‌ করে সেই জাফারুল ইসলামের জন সমর্থনে কি ভাঁটা পড়ল? কেনই বা পাড়ুই এলাকা দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দিল দল? উত্তর খুঁজছে বীরভূম জেলার রাজনৈতিক মহল। চৌমণ্ডলপুর ও মাখড়া গ্রাম যে দু’টি পঞ্চায়েত এলাকায়, সেখানে দল পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের ইলামবাজার ব্লক সভাপতি জাফারুলকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, তাঁর বদলে এখন থেকে ওই এলাকা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুস্তাক হোসেনকে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪৩
Share: Save:

যে নেতার হাত ধরে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিপুল সাফল্য দেখেছিল দল, হঠাত্‌ করে সেই জাফারুল ইসলামের জন সমর্থনে কি ভাঁটা পড়ল? কেনই বা পাড়ুই এলাকা দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দিল দল?

উত্তর খুঁজছে বীরভূম জেলার রাজনৈতিক মহল। চৌমণ্ডলপুর ও মাখড়া গ্রাম যে দু’টি পঞ্চায়েত এলাকায়, সেখানে দল পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের ইলামবাজার ব্লক সভাপতি জাফারুলকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, তাঁর বদলে এখন থেকে ওই এলাকা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুস্তাক হোসেনকে। রবিবার বোলপুরে গীতাঞ্জলি প্রেক্ষাগৃহে দলের জেলা কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দল জাফারুলের ডানা ছাঁটার পরই এমন নানা জল্পনা উস্কে দিয়েছে জেলার রাজনীতিতে।

যদিও ‘ডানা ছাঁটা’-র কথা মানতে চাননি জাফারুল। তাঁর নিজের ব্যাখ্যা, “যে দায়িত্বে ছিলাম, সেই দায়িত্বেই আছি। সংগঠনের কাজের জন্য নতুন করে এলাকা বিভাজন করা হয়েছে মাত্র।” ইলামবাজারের যে দু’টি পঞ্চায়েত এলাকায় সাম্প্রতিক কালে সব থেকে বেশি সমস্যায় জড়িয়েছে তৃণমূল, সেই মঙ্গলডিহি এবং বাতিকার অঞ্চলের দায়িত্ব ওই নেতার হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নতুন দায়িত্বে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মুস্তাক হোসেন।

পাড়ুইয়ের বাসিন্দা মুস্তাক এক সময় সিপিএম করতেন। এরপর কংগ্রেস ও পরে তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূলের স্থানীয় কর্মীদের কথায়, এক সময় এলাকায় ক্ষমতা বাড়িয়ে বিধায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন মুস্তাক। দলের অন্দরের একটি সূত্র বলছে, লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলামের আসনটিতে নিজেকে দাবিদার জানিয়ে রাজ্য স্তরের নেতাদের কাছেও পৌঁছেছিলেন তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পাড়ুই এলাকায় যে ওই নেতার যথেষ্ট দাপট ছিল, সেটা মানছেন বাম নেতারাও। এখন তাঁর হাতেই গেল সেই পাড়ুইয়ের দায়িত্ব।

দলের একটি সূত্রের দাবি, ইলামবাজার ব্লকে একের পর এক এলাকায় বিজেপির আধিপত্য বিস্তার ও মাখড়া-চৌমণ্ডলপুরের ঘটনার পরেই দলের অন্দরে জাফারুলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কানুর, ডোমনপুরে বিজেপি কর্মী খুন এবং মাখড়ায় হামলা-সহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় জাফারুলের নাম জড়ানোয় দলেরই অস্বস্তি বেড়েছে। বিজেপি-র উত্থানে ওই অঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামে ক্রমশ লাগাম আলগা হচ্ছিল জাফারুলেরও। শিয়রে সঙ্কট দেখে তার পরেই দলীয় নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত।

ইলামবাজার ব্লকে তৃণমূলের জনসমর্থন যে কিছুটা কমছে, সেটা এলাকায় ঘুরলেই মালুম হয়। বিরোধী দলের কর্মী খুনের অভিযোগ কিংবা দলবল নিয়ে এলাকায় সন্ত্রাস চালানোর নানা ঘটনার নালিশ এখন হাওয়ায় ঘুরছে জাফারুলের নামে। কেউ কেউ বলছেন, বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্তের তালিকায় তাঁর নাম জড়িয়েছে বলেই কি দল তাঁর প্রতি অন্য রকম সিধান্ত নিল?

অথচ, এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। তৃণমূলের জন্মলগ্ন সেই ১৯৯৮ থেকেই দলের সঙ্গে যুক্ত জাফারুল। মহসিন মণ্ডল নামে ইলামবাজারের প্রাক্তন ব্লক সভাপতিকে সরিয়ে ২০০৩-এ যুব কংগ্রেসের কর্মী জাফারুলের হাতেই ব্লক সভাপতির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল দল। বাম আমলে তৃণমূলের অসময়ে তিনি একার হাতে, দলের সলতে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন ইলামবাজার ব্লকে। সেই সময় জাফারুল এলাকায় ঘুরে ঘুরে সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে তুলে এনেছিলেন অনেক দক্ষ নেতা-কর্মীকেও। তার মধ্যে বিলাতি পঞ্চায়েতের খোদাবক্স কিংবা ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে আসা দুলাল রায় যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন শেখ হাবল বা জাফারুলের ডান হাত বলে পরিচিত ফজলু রহমান ওরফে তরু এবং শেখ কালামও। এলাকার নিচুতলার কর্মীদের একাংশের ক্ষোভ, আস্তে আস্তে জাফারুলের দেওয়া ক্ষমতা ভোগ করে, এঁরাই গোটা এলাকায় ‘দাদা’ হয়ে ওঠেন। তাঁদের রাজনৈতিক ‘গুরু’ অবশ্য ‘দাদাগিরি’-র অভিযোগ নসাত্‌ করে দিয়েছেন। জাফারুলের দাবি, “এলাকায় দাদাগিরির যে অভিযোগ উঠছে, সেটা ঠিক নয়। সবার নিজের দায়িত্ব রয়েছে। দলের পক্ষ থেকে সেটাই পালন করা হয়। পিছন থেকে নয়, সামনে থেকে অভিযোগ করুন।”

জেলার রাজনৈতিক মহল বলছে, জাফারুল স্বীকার না করলেও, ইদানিং তাঁর অনুগামীদের ‘দাদাগিরি’-র দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এলাকা। এই সে দিনও বিজেপি ও গ্রামবাসীদের একটা বড় অংশ অভিযোগ করেছেন, মাখড়ায় জাফারুলের নেতৃত্বেই হামলা হয়েছিল। এর ব্যাখ্যায় জেলায় রাজনৈতিক মহলের একাংশ জানাচ্ছেন, ইলামবাজারের এই তৃণমূল নেতার দাপট শুরু ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই। দলের কাছে নিজের ‘কাজ’ দেখানোর সেরা সুযোগ এসে যায় ওই ভোটেই। সে সময় আবার ব্লকজুড়ে পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির দখলে থাকা বাম দলগুলির মধ্যে চূড়ান্ত অনৈক্য তৈরি হয়েছে। সিপিএম ও ফরওয়ার্ড ব্লকের কিছু শীর্ষ নেতার কথায়, “ইলামবাজারে ১৯৭৭ সালের পর থেকে যতগুলি পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে, তাতে কখনই বামেদের মধ্যে ঐক্য হয়নি। সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে। এতে এলাকার মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়। জাফারুল তারই সদ্ব্যবহার করে সে বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্লকের ২০টি পঞ্চায়েত আসন ও ২টি পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের দখল আনে। ঘুড়িষার মতো দু’একটি পঞ্চায়েতে পিডিসিআই-কে নিয়েও বোর্ড গঠন করে তৃণমূল।

২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও ভাল ফল হওয়ায় এলাকায় ও দলের কাছে জাফারুলের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। যা কাজে লাগিয়ে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে একের পর এক পঞ্চায়েতগুলিতে অনাস্থা এনে দখলে নেয় তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতিও দখলে আসে জাফারুলের। বামেদের ব্যাখ্যা, পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০১৩ সালে থাকলেও ওই সময় নির্বাচিত বোর্ড না থেকেও ক্ষমতা ভোগ করেছে তৃণমূলই। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর থেকেই পঞ্চায়েতগুলি ও পঞ্চায়েত সমিতির দরপত্র ডাকা নিয়ে বিভিন্ন সময় দুনীর্তির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। অভিযোগ ওঠে, টাকার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ারও। সঙ্গে ইলামবাজার ব্লকের বড় অংশজুড়ে বালি-ঘাটে দখল নিয়ে জাফারুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসে পড়ে। এতেই দলের কাছে ভাবমূর্তি খারাপ হতে শুরু করে তাঁর।

কী বলছেন জাফারুল?

বালি ঘাটের টেন্ডার-দুর্নীতি নিয়ে তিনি অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “স্বচ্ছতার সঙ্গেই বালিঘাটের ই-টেন্ডার হয়। বাম আমলের থেকে কর বেশি আদায় হয়েছে তৃণমূলের জমানাতেই।” কর লাভের অঙ্ক যাই বলুক, রাজনীতির অঙ্ক বলছে, একসময় জাফারুল যাঁদের দলে টেনেছিলেন, সেই খোদাবক্স এবং শেখ সদাইয়ের মতো নেতারাও এখন বিজেপি-তে ঝুঁকেছেন। তাতে এলাকায় দিন দিন বিজেপির পাল্লাভারির খবরই বাড়ছে। আর তাতেই দলের এই নতুন সিধান্ত।

যদিও তৃণমূলের অন্দরের খবর, রাজনীতিতে মুস্তাক প্রথম দিকে অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন না। রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন ঘোষেদেরই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলালে তিনিও অনুব্রতর সঙ্গে হাত মেলান। জাফারুল ঘনিষ্ঠেরা অবশ্য বলছেন, “এত দিন পরে জাফারুলের এলাকায় (মঙ্গলডিহি ও বাতিকার পঞ্চায়েত) দায়িত্ব পেয়ে মুস্তাক আসলে অনুব্রত অনুগামী হওয়ারই পুরস্কার পেলেন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bjp parui jafarul islam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE