Advertisement
E-Paper

বাহিনী নেই, হতাশ করল কমিশন

২০০৯ এবং ২০১১-র পুনরাবৃত্তি হল না। বরং এক দশক আগে, ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের স্মৃতি উসকে দিল রাজ্যের তৃতীয় দফার ভোট। ফারাকের মধ্যে, সে বার কাঠগড়ায় ছিল সিপিএম। এ বার তৃণমূল। এবং সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও। ২০০৯-এর লোকসভা এবং ২০১১-র বিধানসভা ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি যথেষ্ট স্বস্তি দিয়েছিল রাজ্যের আমজনতাকে। আধা সামরিক বাহিনী ও ভিন্‌ রাজ্যের পুলিশের নজরদারিতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে বা বুথের ভিতরে রাজনৈতিক বাহিনীর দাপাদাপি কার্যত দেখতে হয়নি তাঁদের।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০৪:২৩

২০০৯ এবং ২০১১-র পুনরাবৃত্তি হল না।

বরং এক দশক আগে, ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের স্মৃতি উসকে দিল রাজ্যের তৃতীয় দফার ভোট। ফারাকের মধ্যে, সে বার কাঠগড়ায় ছিল সিপিএম। এ বার তৃণমূল। এবং সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও।

২০০৯-এর লোকসভা এবং ২০১১-র বিধানসভা ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি যথেষ্ট স্বস্তি দিয়েছিল রাজ্যের আমজনতাকে। আধা সামরিক বাহিনী ও ভিন্‌ রাজ্যের পুলিশের নজরদারিতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে বা বুথের ভিতরে রাজনৈতিক বাহিনীর দাপাদাপি কার্যত দেখতে হয়নি তাঁদের। তিন বছরের মাথায় বুধবার এক লহমায় বদলে গেল ছবিটা। হাওড়া, উলুবেড়িয়া, শ্রীরামপুর, আরামবাগ, হুগলি, বর্ধমান পূর্ব, বর্ধমান-দুর্গাপুর, বোলপুর ও বীরভূম এই ৯টি কেন্দ্রের ভোটে রাজ্যের মানুষ ফের প্রত্যক্ষ করলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ভোটের রাশ সেই শাসক দলের হাতেই। তৃণমূল অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ক’দিন আগেই চার জেলা ঘুরে বীরভূমের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজ্যের বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ বলেছিলেন, “আমাদের কাছে সব ধরনের ওষুধ মজুত। আমরা জানি, কোন রোগে কোন দাওয়াই।” সেই ওষুধ যে কেন্দ্রীয় বাহিনী, সেটাও খোলসা করেছিলেন তিনি। কিন্তু দিনের শেষে পরিষ্কার, কমিশনের ওষুধে মোটেই কাজ হয়নি। বুধবার দিনভর কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কোথাওই তেমন ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। অন্তত গত দু’টো বড় ভোটের মতো তো নয়ই।

২০০৯ ও ২০১১ সালে নির্বাচনের প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী গোটা এলাকার নিয়ন্ত্রণ (এরিয়া ডমিনেশন) নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। এ বার সেই ছবি দেখা যায়নি। এ দিন কোথাও থানায়, কোথাও বা সেক্টর অফিসে বসিয়ে রাখা হয়েছিল ভিন রাজ্যের পুলিশকে। এমনকী, কেতুগ্রামের মতো স্পর্শকাতর এলাকাতেও রুট মার্চের বদলে বাতানুকূল ভলভো বাসে ঘুরে বেড়িয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী।

দিল্লিতে উপ-মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুত্‌সি অবশ্য দাবি করেন, “পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবে শেষ হয়েছে। কোথাও সে ভাবে কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি।” বিরোধীরা যে ন’টি কেন্দ্রেই বুথ দখল, ছাপ্পা, রিগিংয়ের অভিযোগ করেছে, সে কথা তোলা হলে তিনি বলেন, “যেখানে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে, সেখানেই পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন কমিশনের কর্মীরা।” তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে বলে মেনে নিয়েছেন তিনি।

জুত্‌সি জানান, ২০০৯ সালের তুলনায় এ বার বেশি আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে ২০১১ সালের চেয়ে কম। কারণ ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গেই কেবল বিধানসভা নির্বাচন হওয়ায় বেশি পরিমাণে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব হয়েছিল। বাহিনী মোতায়েন নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “যে বুথগুলিকে স্পর্শকাতর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলিতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বাকিদের ব্যবহার করা হয়েছে টহলদারির কাজে।”

কলকাতায় সুধীরকুমারও বলেন, “শান্তিপূর্ণ ভোট করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। যখন যেমন অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে, টহলদার বাহিনীকে তত্‌ক্ষণাত্‌ সেখানে পাঠানো হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, যে সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল না, পর্যবেক্ষকদের সেই সব বুথে অতিরিক্ত নজর দিতে বলা হয়েছিল। কে কোন বুথে কত বার গেলেন, সেই হিসেবও দাখিল করতে বলেছে কমিশন। তা হলে কি ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে? বেলা দু’টো পর্যন্ত বেদী ভবন ছেড়ে না-বেরনো সুধীরকুমারের জবাব, “শান্তিপূর্ণ হয়েছে কিনা জানি না। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।”

বিরোধীরা অবশ্য কমিশনের কথা মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, গলদ ছিল গোড়াতেই। নিয়ম অনুযায়ী মাস তিনেক আগেই জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারেরা ‘স্পর্শকাতর’ ও ‘অতি স্পর্শকাতর’ বুথের তালিকা তৈরি করে জমা দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনে। সেই তালিকা ধরে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে কমিশন। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই তালিকা তৈরির প্রক্রিয়াতেই গোলমাল রয়েছে। করা হয়েছে পক্ষপাতিত্ব। ফলে গোটা প্রক্রিয়াটাই প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

বিরোধীদের এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করছেন না প্রশাসনের কর্তাদের একাংশও। তাঁরা বলছেন, স্পর্শকাতর ও অতি স্পর্শকাতর বুথের তালিকা তৈরি হয় এলাকার ইতিহাস-ভূগোল ধরে। অতীতে সেখানে ভোটের আগে ও পরে কী ধরনের রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছিল, ভোটের দিন সেখানকার পরিস্থিতি কেমন ছিল, পুলিশের সেই সব রিপোর্ট গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখে বুথের গোত্র চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন। ওই কর্তাদের বক্তব্য, ভোটের কয়েক দিন আগে ওই বুথের তালিকা সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকের কাছে জমা পড়লেও শেষ মুহূর্তে তার খুব একটা অদলবদল করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ভিন্‌ রাজ্য থেকে আসা কমিশনের পর্যবেক্ষকদের পক্ষে এলাকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দ্রুত বুঝে ওঠাও কঠিন। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের তৈরি তালিকার উপরেই তাঁদের নির্ভর করতে হয়।

এ দফার ভোটে কমিশন সেই ফাঁদেই পড়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে পাঁচ জেলার পুলিশ সুপার, এক জেলাশাসক ও দুই অতিরিক্ত জেলাশাসককে সরিয়ে দেওয়া পরে একাধিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “দিল্লি থেকে লোক এনে তো নির্বাচন হবে না। যাঁদের সরিয়ে দেওয়া হল এবং যাঁদের আনা হল, তাঁরা সবাই আমারই অফিসার।” এ দিন যা ঘটল, তার ইঙ্গিত মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই ছিল বলে বিরোধীদের অভিমত।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

সুতরাং বুধবার দিনভর ভোটপর্ব নিয়ে নালিশ জানিয়ে গিয়েছেন বিরোধী নেতারা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “নির্বাচন কমিশন আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় দফার নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রিগিং, বুথ দখল, এজেন্টদের বুথে ঢুকতে না দেওয়া, এ সবের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট, এই দফায় কমিশনের ব্যবস্থা সব থেকে শিথিল।” কেন্দ্রীয় বাহিনীর অপ্রতুলতা এবং তাদের মোতায়েন করা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সূর্যবাবু। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, “তৃতীয় দফায় মানুষের মতামতের উপরে ভরসা না করে সন্ত্রাসের পথে গিয়েছে তৃণমূল। কমিশনও ভোট পরিচালনায় ব্যর্থ।” বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও কমিশনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেন, “এ রকম চলতে থাকলে ভোট হওয়া, না হওয়া সমান।”

এর বিপরীতে দৃশ্যতই স্বস্তিতে শাসক শিবির। বেশির ভাগ নেতাই ছিলেন খোশ মেজাজে। ভোট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “এটা আমরা বলব কী! বলবে তো কমিশন।” আর দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, “তৃণমূল হচ্ছে সেই ভাল ছাত্র, যে তিন বছর ধরে মন দিয়ে পড়াশোনা করেছে। ফলে পরীক্ষার দিন আমরা অনেক আরামে ও নিশ্চিন্তে আছি!”

কিন্তু এ দিন ৯টি কেন্দ্রে যে হারে ভোট পড়েছে, সেটাই শাসক দলের বুথ দখল ও একতরফা ভোটের প্রমাণ এবং স্বস্তির নেপথ্য কারণ বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বেলা ১টা পর্যন্ত ভোটের হার ছিল গড়ে ৬১ শতাংশ। দুপুর ৩টেয় তা ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কমিশন অবশ্য ভোট পড়ার এই হারে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখছে না। তাদের মতে, ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ততার জেরেই সকাল থেকে দ্রুত গতিতে ভোট পড়েছে। রাতে গিয়ে ভোটদানের হার হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। যা আগের দু’দফা ভোটের সমান।

কিন্তু সূর্যবাবুর অভিযোগ, “আরামবাগে ভোটই হয়নি। ভোটকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বাকি আটটি কেন্দ্রের ১৫,২৭৭টি বুথের মধ্যে ৮২৬টি বুথে পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।” এর মধ্যে বীরভূমে ৩৩টি, বোলপুরে ৩৩৩টি, বর্ধমান-দুর্গাপুরে ১৫৭টি, বর্ধমান-পূর্বে ১৪১টি, হুগলিতে ৬০টি, শ্রীরামপুরে ২৫টি, হাওড়ায় ২৪টি এবং উলুবেড়িয়ায় ৫০টি বুথে ফের ভোট চেয়েছেন তাঁরা। বিজেপি এবং কংগ্রেসও পৃথক ভাবে বেশ কিছু বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জুত্‌সি বলেন, “অনেকগুলি বুথ নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ এসেছে। সে সব বুথের রিটার্নিং অফিসার, কমিশনের কর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বৈঠক হবে। যেখানে প্রার্থীরাও উপস্থিত থাকবেন। ওই বুথের ভিডিও রেকর্ডিং খতিয়ে দেখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাতে যদি কোনও কেন্দ্রে কারচুপি ধরা পড়ে তা হলে ওই কেন্দ্রে পুনরায় নির্বাচন হবে।”

commission para military force
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy