Advertisement
E-Paper

বড়দিনের সন্ধ্যায় মাতৃমন্দিরে সুরের প্রণাম

এমন বড়দিন সচরাচর আসে না। দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর ঘরের দালানে আরতির ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের পবিত্র গন্ধের রেশটুকু ছুঁয়েই যখন বহতা হয় সুরের নদী।

ঋ\জু বসু

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪৬
বড়দিনে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে উস্তাদ আমান আলি খান। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

বড়দিনে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে উস্তাদ আমান আলি খান। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

এমন বড়দিন সচরাচর আসে না।

দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর ঘরের দালানে আরতির ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের পবিত্র গন্ধের রেশটুকু ছুঁয়েই যখন বহতা হয় সুরের নদী। যিশু ও স্বামী বিবেকানন্দের ছবিতে সাজানো মঞ্চের মাঝখানেই ‘জায়ান্ট স্ক্রিন’। সেখানে ফুটে উঠছে সালঙ্কারা মাতৃপ্রতিমার ছবি। কথামৃতে যেমনটি বলা আছে, রামকৃষ্ণের পছন্দের আভরণে কানপাশা, নূপুর, বাউটিতে বড়দিনে সাজানো হয়েছে মাতৃমূর্তি।

ঠিক যেন তাঁর কোলের কাছটিতে বসে সরোদে সুরসংযোগ করলেন উস্তাদ আমান আলি খান। বৃহস্পতিবার ‘মায়ের দরবারে’ উপস্থিত বিদগ্ধজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার আগে যিনি বললেন, ‘‘নমস্কার। মেরে লিয়ে ইয়ে বহুত হি বড়া দিন হ্যায়।”

সুরের মোহনায় মিলে গেল দু’টি স্মরণীয় লগ্ন। যিশুর জন্মদিন তো বটেই, তার সঙ্গে কত দিনের পুরনো এক ক্রিসমাস ইভের স্মৃতি। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে একঝাঁক বাঙালি তরুণ এক মন-প্রাণ হয়েছিলেন অন্য এক সঙ্কল্পে। ১২৮ বছর আগে আঁটপুরে নরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে গভীর রাতে ধুনি জ্বেলে সংঘশক্তির জোরে ত্যাগ ও সেবার সন্ন্যাসব্রতে শপথ নিয়েছিলেন জনা বারো গুরুভাই। কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে হুগলির গাঁয়ে এক সতীর্থের জমিদারি-বাড়ির আশ্রয়ে রামকৃষ্ণ-পার্শ্বদদের খেয়াল ছিল না, সেটাই বড়দিনের আগের সন্ধ্যা। কিন্তু কী আশ্চর্য, যিশুর কথাতেই সে-দিন গুরুভাইদের উদ্বুদ্ধ করেন ভাবী কালের বিবেকানন্দ। আমানের সান্ধ্য উপস্থাপনা সেই ইতিহাসেরও স্মারক হয়ে উঠল।

কলকাতার সঙ্গে কয়েক যুগের আত্মীয়তার এক পরম্পরাতেও এ যেন নতুন অধ্যায়। আমানের বাবা উস্তাদ আমজাদ আলি খান তো বটেই, ঠাকুরদা উস্তাদ হাফিজ আলি খানের জমানা থেকেই কলকাতার বড় আদরের এই পরিবার। হাফিজ আলি খান সাহেবের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল সঙ্গীতকার রাইচাঁদ বড়াল, পাথুরিয়াঘাটার সঙ্গীত-রসিক মন্মথ ঘোষদের। দক্ষিণেশ্বরের মাতৃমন্দিরের ‘বড়দিনে’ আমানের উপস্থিতি শতাব্দী-প্রাচীন সেই সেতু আরও সুদৃঢ় করল। সকালেই টুইটারে দক্ষিণেশ্বরের অনুষ্ঠানের কথা জানিয়েছিলেন হিন্দুস্থানী রাগ সঙ্গীতের ঘরানার প্রথম সারির এই উত্তরাধিকারী। তাঁর নিবেদনের ফাঁকে বারবার বললেন, “এই মহান স্থানে অনুষ্ঠান করতে পারা আমার সৌভাগ্য।”

মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির সময়েই এই ‘সুর-লহর’-এর মঞ্চে উপনিষদের সচ্চিদানন্দ স্বরূপের কথা বলছিলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের সম্পাদক স্বামী সর্বগানন্দ। কথায় কথায় উঠে আসে যিশুর ‘সারমন অন দ্য মাউন্ট’-এর সেই বহুচর্চিত উচ্চারণ যাদের অন্তঃকরণ পবিত্র তারাই ঈশ্বরলাভ করে। তবলা-শিল্পী পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গতে রাগ উপস্থাপনার বন্দিশ-পর্বে এক ধরনের দিব্য আনন্দানুভূতিই যেন সঞ্চারিত হল দক্ষিণেশ্বর প্রাঙ্গণের শীত-সন্ধ্যায়। মঞ্চের কাছটিতে ছাউনির নীচে বসে কিংবা ব্যারিকেডের ও-পারে দাঁড়িয়ে সেই আনন্দের ভাগ পেলেন নামী-অনামী শ্রোতারা।

বড়দিনের দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের ভিড় বরাবরের। গর্ভগৃহমুখী লাইনে দাঁড়িয়েই অনেকে সরোদ-তবলার সংলাপে বুঁদ হয়েছেন। দুই যুবক-যুবতী, বরানগরের শুভদীপ ত্রিপাঠী ও বেলঘরিয়ার শ্রাবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় খোলা আকাশের নীচে ব্যারিকেড ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বললেন, “আজ শুধু এই সুরের টানেই এসেছি।” তিন দশক আগে দক্ষিণেশ্বরে অনুষ্ঠান করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। কিন্তু বড়দিনের সন্ধ্যায় এমন অনুষ্ঠান দুর্লভ।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির অবশ্য আমানের অচেনা নয়। পরে বলছিলেন, “আমার মা অসমের মেয়ে। ওঁর কাছে কামাখ্যার মতো দক্ষিণেশ্বরের কথাও অনেক শুনেছি। তিন মাস আগে এখানে আরতি দেখেছিলাম। এখানে বাজাতে পারাটা আশীর্বাদ।” মন্দিরে এসে অছি পরিষদের সম্পাদক কুশল চৌধুরীর সঙ্গে প্রথমে প্রতিমা দর্শন করেন আমান। সন্ধের দু’টি ঘণ্টার পরিসরে তিনটি রাগের ডালি সাজিয়েছিলেন তিনি। মাতৃবন্দনার অনেক গানই রাগ ভীমপলশ্রীতে। সেই আর্তির রেশ ধরে নিবেদন করলেন মায়ের নামের রাগ, দুর্গা। তার পরে দেশ রাগ। স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের কণ্ঠে উপনিষদের সবাইকে কাছে টানার ‘মা বিদ্বিষাবহৈ’ ডাকে শুরু হয়েছিল আসর। হর্ষ দত্ত মনে করিয়েছিলেন, বিবেকানন্দের চেতনায় ফারাক ছিল না খ্রিস্ট ও রামকৃষ্ণে। শেষে থাকল দেশ রাগের আহ্বান।

তত ক্ষণে গর্ভগৃহ বন্ধ। শ্রোতারা, মন্দিরে আসা ভক্তরা তবু মুগ্ধতায় অচঞ্চল। শেষ ডিসেম্বরের গঙ্গার হাওয়াও যেন কারও গায়ে লাগছে না।

সরোদের সুরমূর্চ্ছনা এই বড়দিনের শেষ কথাটা বলে গেল।

riju basu christmas sarod
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy