অন্ধকার জাতীয় সড়ক। হুড খোলা একটা জিপ আসছে ডালখোলা থেকে কানকির দিকে।
জিপের চালকের আসনের পাশে তিনি করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জিপের উইন্ড স্ক্রিনের মাথার দু’পাশে লাগানো দু’টি বেবি স্পটের আলো পড়েছে তাঁর মুখে। তাঁর পরনে গেরুয়া জমির উপর লাল পাড়ের শাড়ি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে জিপের উপরে যেন তাঁর ‘কাট আউট’। ধীর, শান্ত একটা মূর্তি।
কানকির মাটিয়ারির বাড়িতে তিনি যখন নামলেন, দীপা দাশমুন্সিকে কাছ থেকে দেখে কিন্তু অন্য কথা মনে হল। হয়তো বাইরে শান্ত রেখেছেন নিজেকে। কঠিন চোখমুখ জানান দিচ্ছে, লড়াই এ বার যথেষ্ট কঠিন।
পাঁচ বছর আগে লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর সময় রায়গঞ্জের ‘বৌদি’র বাড়তি শক্তি ছিল অসুস্থ স্বামী প্রিয়রঞ্জনকে ঘিরে আবেগ। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এখনকার মতো প্রকাশ্যে বিরূপ ছিলেন না। সেই পরিস্থিতির ‘পরিবর্তন’ হয়েছে। আবেগও থিতিয়েছে। রায়গঞ্জের উন্নয়নে কী কী করেছেন, পুস্তিকা ছাপিয়ে এখন তার ফিরিস্তি দিতে হচ্ছে দীপাকে। বস্তুত, এই প্রথম একদম একা লড়ছেন তিনি।
দীপা নিজেও মেনে নিলেন, “এ বার একটু চাপ আছে। রায়গঞ্জে বহু প্রার্থী।” এর পরে যেটা যোগ করলেন, তাৎপর্যপূর্ণ। বললেন, “দেশ জুড়ে মোদী-হাওয়াও তো আছে।” তবে একই সঙ্গে প্রিয়-ঘরণী মনে করিয়ে দিলেন, রায়গঞ্জে একমাত্র মহিলা প্রার্থী তিনিই। সেটা তাঁর ‘বাড়তি সুবিধে’।
কিন্তু একটা মস্ত অসুবিধেও তো রয়েছে। যেটা নিয়ে প্রায় রোজই চর্চা চলেছে সংবাদমাধ্যমে। অজস্র প্রতিবেদন, এক শিরোনাম ‘দেওর-বৌদির লড়াই’ কিংবা ‘দাশমুন্সি পরিবারে ফাটল ধরিয়ে ছাড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!’
প্রিয়রঞ্জনের ভাই, তৃণমূলের রায়গঞ্জের প্রার্থী পবিত্ররঞ্জন দাশমুন্সি (লোকমুখে ‘সত্যদা’) কালিয়াগঞ্জের শ্রী কলোনির বাড়িতে বসে দাবি করেছেন, রায়গঞ্জে উন্নয়নের জন্যই তাঁর জেতাটা দরকার। বৌদিকে পরোক্ষে তোপ দেগে তিনি বলেছেন, “রায়গঞ্জে গত পাঁচ বছরে কোনও উন্নয়ন নেই। রাজ্য সরকার সহযোগিতা না করলে উন্নয়ন হবে না। আমি সেই কারণেই দিদির দলে যোগ দিয়েছি। দিদি তো উন্নয়নের প্রতীক।’’
জিততে পারবেন কি? সত্যবাবুর জবাব, “দাদাকে স্মরণ করছি। বাকিটা ওপরওয়ালার হাতে!”
বিরোধী সব শিবির বাম, বিজেপি, এমনকী সমাজবাদী পার্টির লোকজনেরাও উপভোগ করছেন দেওর-বৌদির লড়াই। করণদিঘির সাবধান এলাকায় প্রচারের ফাঁকে সিপিএমের প্রার্থী মহম্মদ সেলিম তা নিয়ে খোঁচাও দিলেন, “পাঁচ বছরের মধ্যে সাড়ে তিন বছর দিদি-বৌদির দলের কাজিয়া চলেছে। এ বার রায়গঞ্জের মানুষ দেওর-বৌদির ঝগড়া দেখতে চায় না।”
আসলে ব্যাপারটা হল, ‘বৌদি’র এ বারের প্রতিপক্ষরা সকলেই মোটামুটি একটা সাড়া ফেলতে পেরেছেন রায়গঞ্জে। ‘বহিরাগত’ তকমা ঘোচাতে মরিয়া সেলিম ঘুরছেন গ্রামে-গ্রামে। প্রবীণ অভিনেতা তথা রায়গঞ্জের ভূমিপুত্র নিমু ভৌমিককে প্রার্থী করে হঠাৎ আলো টেনেছে বিজেপি। এমনকী সপা-র প্রার্থী সুদীপরঞ্জন সেনও বেশ নজর কাড়ছেন। মুলায়ম সিংহের ঘনিষ্ঠ, সল্টলেকের বাসিন্দা সুদীপবাবু কলকাতা থেকে নিয়ে গিয়েছেন মান্না দে-র ভাইপো সুদেব দে, বেতার-দূরদর্শনের সংবাদপাঠক তরুণ চক্রবর্তীকে। তাঁরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে লোক জমাচ্ছেন। সুদীপবাবু নিজেও গান গাইছেন, ‘মন চল নিজ নিকেতনে।’ সুদীপবাবুর সেই গান নিয়ে দীপার কটাক্ষ, “রায়গঞ্জে কেন? উনি নিজ নিকেতনেই চলে যান!”
বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ টিপ্পনি কাটছেন, সুদীপবাবুকে নিজ নিকেতনে যেতে বলছেন যিনি, তিনি নিজ-ঘরে নিশ্চিন্ত তো? বামেদের কিন্তু দাবি, রায়গঞ্জে দীপার ভিত আলগা হয়েছেই। তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভাঙার পরে গত পঞ্চায়েত ভোটে উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদ হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। ক্ষমতায় এসেছে বামেরা। এ বার সেলিম প্রচারে নেমে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়েছেন। কারণ, দীপা ইউপিএ-২ সরকারের মন্ত্রীও বটে। আবার সাংসদ হিসেবেও দীপাকে ‘ব্যর্থ’ প্রমাণ করতে জেলায় অনুন্নয়নের অভিযোগ তুলছেন সেলিম। জোট ভাঙার পরে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল গড়ার দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন দীপা। সেই প্রসঙ্গ তুলে প্রচারে সেলিম বলছেন, “এইমস একটা বড় ভাঁওতা।” দীপার পাল্টা জবাব, “কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়নি বাম আমলে। পরে মমতা-সরকারও বাধা দিয়েছে। আসলে যাঁরা ভাঁওতা দিয়েছেন, তাঁদের উপযুক্ত জবাব দেবেন রায়গঞ্জের মানুষ।’’
দীপারা বোঝাতে চান, রায়গঞ্জে শক্তপোক্তই আছে তাঁদের জমি। জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ বিশ্বাস-সহ দলের অনেকেই পঞ্চায়েত ভোটের ফলের নিরিখে লোকসভা ভোটকে দেখতে নারাজ। দীপাও মনে করাচ্ছেন, “ব্যাপক সন্ত্রাসের মধ্যেও ত্রিমুখী লড়াইয়ে জিতে কংগ্রেস ডালখোলা, ইসলামপুর, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ পুরসভা দখলে রেখেছে।”
কার জমি বাড়ল, কার কমলো কংগ্রেস-তৃণমূল-বামেদের লড়াইয়ের মূল সুর যখন এই, তখন স্রেফ ভোট-ভাগাভাগির সুযোগে বাজিমাতের আশায় আরও দুই দল। রায়গঞ্জের বিজেপি নেতারা জয়ের স্বপ্নই দেখছেন। জেলা সভাপতি শুভ্র রায়চৌধুরীর কথায়, “রায়গঞ্জে এ বার লড়াই পঞ্চমুখী। কংগ্রেস-তৃণমূলের মতো বামেদের ভোট কাটাকাটি হবে। বামেদের ভোটের সিংহভাগই টানবে সপা।” সুভাষ চক্রবর্তীর একদা ঘনিষ্ঠ, নিমুবাবুও কি ‘পদ্মফুলে’ জয়ের গন্ধ পাচ্ছেন? তাঁর সহাস্য মন্তব্য, “জয়ের গন্ধ কিনা জানি না, মানুষের ভালবাসার গন্ধ পাচ্ছি।”
একই অঙ্কে জয়ের গন্ধ পাচ্ছেন সপা-র সুদীপবাবুও। তাঁদের জেলা সভাপতি অরুণ দে দাবি করেছেন, বাম-ভোট তাঁরা অনেকটাই টানবেন। কেন? অরুণবাবুর ব্যাখ্যা, “রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী থাকাকালীন কিরণময় নন্দ জেলায় যে কাজ করেছিলেন, এ বার তার স্বীকৃতি আমরা পাব।”
গত বিধানসভা ভোটে অবশ্য রায়গঞ্জে ২৭০০ ভোটে হেরেছিলেন কিরণময়বাবু। পঞ্চায়েত ভোটেও সপা সুবিধে করতে পারেনি। ফলে সপা তাঁদের ভোটে আদৌ থাবা বসাতে পারবে না বলেই আত্মবিশ্বাসী সিপিএমের জেলা সম্পাদক বীরেশ্বর লাহিড়ী। তাঁর দলের নিচু তলার কর্মীদের যদিও শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক-কে নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। ছ’মাস আগে পঞ্চায়েত ভোটে বেশ কিছু আসনে সিপিএম-ফব সমঝোতা হয়নি। বীরেশ্বরবাবু অবশ্য সে সব চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, এ বার বামফ্রন্টের সার্বিক ঐক্যই তাঁদের জয় নিশ্চিত করবে। বস্তুত, মাঠে-ঘাটে সেলিমের প্রচারসঙ্গী হিসেবে চাকুল কাটাকাটির শেষ অঙ্কের উত্তর মিলবে ১৬ মে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy