Advertisement
E-Paper

ভিন্ন স্বরের মাসুল পুলিশি হেনস্থা, এ বার সুমন

আহত অভিনেত্রী নিজে কোনও অভিযোগ আনেননি। তাঁর আঘাতের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কেউ দায়ী, এমন নালিশও ঠোকেননি। হোটেলের ঘরে হামলা বা ভাঙচুর চালিয়েছেন, এমন কোনও অভিযোগ হোটেল কর্তৃপক্ষের তরফে নেই। হোটেলের বুকিং তাঁর নামে ছিল না। ফলে বিল মেটানোর দায়ও তাঁর নেই। অথচ তাঁর বিরুদ্ধেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ (প্রতারণা), ৪২৭ (ভাঙচুর), ৪০৬ (বিশ্বাসভঙ্গ) ও ৩৪ (সম্মিলিত ষড়যন্ত্র) ধারায় মামলা আনার চেষ্টা হল! তিনি নাট্যব্যক্তিত্ব-চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৪ ০৩:৩৭
সল্টলেকের বাড়িতে সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সল্টলেকের বাড়িতে সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

আহত অভিনেত্রী নিজে কোনও অভিযোগ আনেননি। তাঁর আঘাতের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কেউ দায়ী, এমন নালিশও ঠোকেননি।

হোটেলের ঘরে হামলা বা ভাঙচুর চালিয়েছেন, এমন কোনও অভিযোগ হোটেল কর্তৃপক্ষের তরফে নেই।

হোটেলের বুকিং তাঁর নামে ছিল না। ফলে বিল মেটানোর দায়ও তাঁর নেই।

অথচ তাঁর বিরুদ্ধেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ (প্রতারণা), ৪২৭ (ভাঙচুর), ৪০৬ (বিশ্বাসভঙ্গ) ও ৩৪ (সম্মিলিত ষড়যন্ত্র) ধারায় মামলা আনার চেষ্টা হল!

তিনি নাট্যব্যক্তিত্ব-চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়।

নিউটাউনের একটি হোটেলের ঘরে অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের আহত হওয়ার ঘটনায় সুমনকে জড়িয়ে একাধিক ধারায় মামলা আনতে উদ্যোগী হয়েছিল বিধাননগর পুলিশ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খাতায়-কলমে অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি তারা। টানা ২২ ঘণ্টা আটকে রেখে বিস্তর হয়রানির পরে সুমন সোমবার বিকেলে ছাড়া পেয়েছেন।

গোটা ঘটনায় পুলিশ যে ভাবে প্রয়োজনীয় অভিযোগপত্র ছাড়াই আগ বাড়িয়ে সুমনকে কার্যত ফাঁসাতে চেয়েছে, সেটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করছেন নাগরিক সমাজের একাংশ। অনেকেরই প্রশ্ন, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ না হওয়ার জন্যই কি সুমনের এই হেনস্থা?

বামফ্রন্ট আমল থেকেই রাজ্য সরকারের সমালোচক বলে পরিচিত ছিলেন সুমন। তার পর মমতা জমানাতেও নানা ঘটনায় শাসক দলের সমালোচনায় সরব হয়েছেন তিনি। তাঁকে প্যাঁচে ফেলতে পুলিশি তৎপরতার মধ্যে অনেকেই তাই শাসক দলের প্রতিহিংসার প্রকাশ দেখছেন। সুমনের নিজেরও আশঙ্কা, “এর পরে আরও নানা ভাবে হয়রানির শিকার হতে পারি আমি।”

এই ঘটনার পরে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে এর পর তবে কে? সুমনের মতোই সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন আরও অনেকে। অনেকেরই জিজ্ঞাসা, কোনও না কোনও অছিলায় তাঁদের উপরেও কি নেমে আসবে পুলিশি দাদাগিরি? ঠিক যেমন ভোট চলাকালীন অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছিল আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী, গায়ক বাবুল সুপ্রিয়-র বিরুদ্ধে! ঠিক যেমন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় তড়িঘড়ি থানায় তলব করা হয়েছিল রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, সিপিএম নেতা গৌতম দেব এবং প্রাক্তন সাংসদ সুজন চক্রবর্তীকে!

সুমনের ব্যাপারে পুলিশ যে ভাবে মরিয়া হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জোগাড় করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে, তাতে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। ২৪ মে, শনিবার ভোরে নিউটাউনের হোটেলে স্বস্তিকা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হন। পুলিশের দাবি, সুমন ও স্বস্তিকা ২২ মে, বৃহস্পতিবার রাত থেকে ২৪ মে সকাল পর্যন্ত ওই হোটেলে এক সঙ্গে ছিলেন। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে তার প্রমাণও রয়েছে।

শনিবার রাতে স্বস্তিকার সঙ্গে হাসপাতালে কথা বলে পুলিশ। কিন্তু স্বস্তিকা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। সেই রাতেই সুমনের বাড়িতেও যায় পুলিশ। সুমন তখন ইডেনে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়, রবিবার দুপুরে বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় হাজিরা দিতে। সুমন জানান, তিনি বিকেলে যাবেন। রবিবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ তিনি থানায় যান। পরে রাতে তাঁকে নিউটাউন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সুমনের ভাই সুজন মুখোপাধ্যায় ও থিয়েটারে তাঁদের এক সহযোগী বন্ধু সেখানেই সুমনের খাবার এবং ওষুধ নিয়ে যান। সুজনের কথায়, “রাতে দাদাকে একটি ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। কিছু বলার থাকলে সকালেও তো ডাকা যেত!”

কিন্তু স্বস্তিকা নিজে অভিযোগ না করলে কীসের ভিত্তিতে সুমনকে জেরা করা হল? বিধাননগর পুলিশের এডিসি সন্তোষ নিম্বলকর দাবি করছেন, হোটেল কর্তৃপক্ষ সুমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।

স্বস্তিকা হোটেল ছাড়ার সময়ে পুরো বিল মেটানো হয়নি। এই বিষয়টি তুলে ধরেই সুমনকে পুলিশ বিপদে ফেলার চেষ্টা করেছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ। অথচ হোটেলের ঘর ‘বুক’ করা ছিল স্বস্তিকার নামে। ফলে বিল মেটানোর দায় সুমনের উপরে বর্তায় না। দুর্ঘটনার সময়ে বিয়ারের বোতল ও কিছু কাচের বাসন ভেঙেছিল ঘরে। তার থেকেই হোটেলে ভাঙচুর চলেছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে পুলিশ।

হোটেল কর্তৃপক্ষ কী বলছেন? পাঁচতারা ওই হোটেলের অন্যতম কর্ণধার হর্ষ নেওটিয়া বলেন, “হোটেলের রোজকার পরিচালনার বিষয়টি আমি খোঁজ রাখি না। হোটেলের কর্মী বা মুখপাত্ররা এ নিয়ে বলতে পারবেন।” হোটেলের ডিরেক্টর (সেল্স অ্যান্ড মার্কেটিং) অনুজ বিদানি স্পষ্ট বলছেন, “আমরা কোনও অভিযোগ দায়ের করিনি।”

তা হলে হোটেলের তরফে অভিযোগ এল কোথা থেকে? পুলিশ সূত্রের খবর, রবিবার রাতেই হোটেলের জনা দুয়েক সাধারণ কর্মীকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের দিয়ে সুমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করানোর চেষ্টা হয় বলেও একাংশের দাবি। কিন্তু তাঁরা সিসিটিভি-র ফুটেজে যা পাওয়া গিয়েছে, সেটুকুই পুলিশকে বিবৃত করেন বলে খবর।

তা হলে সুমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদৌ দায়ের করলেন কে? বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ বলেন, “একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। কাদের অভিযোগ বলব না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

পুলিশের একাংশই জানাচ্ছেন, সুমনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য নথি তৈরি হয়েছিল। সুমনকে গ্রেফতার করে বারাসত আদালতে তোলা হবে বলে সোমবার দুপুরে থানায় তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষাও করানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবেই এ দিন অন্তত খাতায়-কলমে অভিযোগ দায়ের করা যায়নি। বিকেল তিনটে নাগাদ সুমনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের কাছে সুমনের বয়ান অনুযায়ী, শনিবার ভোরে পড়ে গিয়ে স্বস্তিকার হাতে কাচ বিঁধে যায়। স্বস্তিকা নিজেই সুমনকে খাবারের বিল মিটিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। সুমন তা-ই করেন। কিছু ক্ষণ বাদে স্বস্তিকার বন্ধুরা এসে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করান। সুমন পুরো বিষয়টা ‘অত্যন্ত ব্যক্তিগত’ বলে মন্তব্য করেছেন। স্বস্তিকার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাঁর বোন অজপা মুখোপাধ্যায় বলেন, “স্বস্তিকা খুব ক্লান্ত। এই বিষয় নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাইছেন না।”

তবে সংস্কৃতি জগতের অন্দরে অভিযোগ উঠেছে, সুমনের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য নাট্যকর্মী-সাংসদ অর্পিতা ঘোষকে দিয়ে স্বস্তিকাকে এক দফা রাজি করানোর চেষ্টা হয়েছিল। তবে সে কথা অস্বীকার করে অর্পিতার দাবি, “স্বস্তিকার সঙ্গে আমার আলাপ নেই, কোনও দিন কথাও হয়নি। সুমন ও স্বস্তিকার কী সম্পর্ক, তা নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই।”

অথচ নাট্যব্যক্তিত্বদের মধ্যেই কেউ কেউ মনে করছেন, প্রতিবাদী স্বর বলেই সুমনকে তার মাসুল দিতে হল এবং এ ব্যাপারে নাট্যজগতের একাংশের হাত থাকাও অস্বাভাবিক নয়। নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন যেমন বলেন, “সরকার বা শাসক দলের ভিতরে একটা অংশই এ সব করছেন। একেবারে উঁচুতলার কেউ বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল না-ও থাকতে পারেন। তবে একটা অংশ হয়তো ভাবছে, এ ভাবে সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের নম্বর বাড়ানো যাবে।” কৌশিকের কথায়, “নাট্যজগতের কোনও অংশ এই চক্রান্তে শরিক হলে অবাক হব না।” রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু বা অর্পিতা ঘোষ যদিও এই ধরনের অভিযোগের জবাব দিতে চাননি। ব্রাত্য বলেন, “কী হয়েছে, কিছুই জানি না!” আর অর্পিতার বক্তব্য, “আমি মনে করি না, নাট্যজগতের কেউ এমন নীচতার আশ্রয় নেবেন।”

তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করলে ফৌজদারি মামলা রুজু করার নমুনা এ রাজ্যে একাধিক রয়েছে। শুধু বাবুল সুপ্রিয়-গৌতম দেব-সুজন চক্রবর্তী নন, ইন্টারনেট থেকে শুরু করে জনসভা সামান্যতম প্রতিবাদ-মস্করার পরিণামেও গ্রেফতার এবং পুলিশি হয়রানি সরকারি দাওয়াই হিসেবে বারবার ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে গত তিন বছরে। অম্বিকেশ মহাপাত্র বা শিলাদিত্য চৌধুরীরা তার উদাহরণ। সর্বশেষ সংযোজন সুমন।

swastika mukhopadhyay suman mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy