• তাঁর বিরোধিতায় মঞ্চে উঠেও পদক-শংসাপত্র নিতে অস্বীকার করেছেন বহু ছাত্রছাত্রী। তবু খোদ উপাচার্যের দাবি, “সমাবর্তন সফল।”
• তাঁর ভূমিকা ও আচরণে ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক তাঁকে উপাচার্য-পদে চান না। তাঁর দাবি, “বিরোধিতা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ছোট’ অংশের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।”
• তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সাড়ে তিন মাস ধরে প্রায় গোটা রাজ্যেরই ছাত্র ও শিক্ষকসমাজ সরব। রাজ্যের বিরোধী দলগুলি তো বটেই, এখন এমনকী শাসক দলের পক্ষ থেকেও সেই দাবি উঠেছে। কিন্তু তিনি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী সোমবারেও জানিয়ে দিয়েছেন, পদত্যাগের কথা ভাবছেন না। এবং এ-সব নিয়ে তাঁর টেনশন একেবারে ‘জিরো’!
“আমি খুবই ভাল আছি। কোনও চাপ নেই। কোলেস্টেরল নেই। ব্লাড সুগার নেই। রক্তচাপ স্বাভাবিক। টেনশন জিরো,” বলছেন উপাচার্য।
কিন্তু চতুর্দিকে তাঁর পদত্যাগের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে যে?
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে প্রশ্নটা নস্যাৎ করে উপাচার্যের জবাব, “সমাজের মানুষ আমার সঙ্গে আছেন। যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটি, কত অচেনা লোক যেচে আলাপ করে আমাকে সমর্থন জানিয়ে যান। সমর্থন জানিয়ে রোজ অন্তত ৫০টা ফোন পাই। কত লোক দেখা করতে আসেন অফিসে। সকলকে সময়ই দিতে পারি না!”
তবে উপাচার্যের এমন দাবির কথা শুনে যাদবপুরের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকের বক্তব্য, সমাজ নয়, রাজ্য সরকারের বকলমে শাসক দলের সমর্থনই রয়েছে তাঁর পাশে। আর এই সমর্থনকে পুঁজি করেই রাজ্যের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক-ছাত্র এবং আরও বহু মানুষের বিরোধিতা সত্ত্বেও চেয়ার আঁকড়ে বসে আছেন অভিজিৎবাবু।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বড় অংশ এবং পড়ুয়াদের অভিজিৎ-বিমুখতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক শিবিরও আসরে নেমেছে। উপাচার্যকে নিয়ে কার্যত নাজেহাল শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিরোধীদের কোনও দাবিকে এখনই আমল দিতে রাজি নন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও যে অভিজিৎবাবুর পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছে, সেই বিষয়ে এ দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বিরোধীরা যা দাবি করবে, তা-ই করতে হবে নাকি? উপাচার্য কী করবেন, সেটা কি বিমান বসু বা সূর্যকান্ত মিশ্র ঠিক করে দেবেন? উপাচার্য নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নেবেন।” আর উপাচার্য বলেছেন, “আমি পদত্যাদের কথা ভাবছি না।”
সমাবর্তন মঞ্চে উপাচার্য থাকায় আচার্য-রাজ্যপালের এগিয়ে দেওয়া পদক-শংসাপত্র ফিরিয়ে দিয়ে গত বুধবার শিরোনাম হয়েছিলেন যাদবপুরের কলা শাখায় এ বারের সেরা ছাত্রী গীতশ্রী সরকার। শুক্রবার পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ওই ছাত্রীর ‘অহিংস’ আন্দোলনের প্রশংসা করে তাঁকে সম্মান জানান। পরের দিন রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডেও পরোক্ষে উপাচার্যের পদত্যাগের কথাই বলেন। ওই দিনই কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় প্রশ্ন তোলেন, “উপাচার্যের কি কোনও আত্মসম্মান বোধ নেই?”
ছাত্রছাত্রীদের কলরবে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরই সুর মেলায়নি। অভিজিৎবাবুর বিরুদ্ধে রব উঠেছে শাসক দলের অন্দরেও। এই অবস্থায় ভাল থাকা নিয়ে উপাচার্যের সরব ঘোষণায় বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও সুব্রতবাবুর বক্তব্য নিয়ে দলের অভ্যন্তরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং এই বিষয়ে দলের ‘লাইন’ কী, সেটা জানিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। উপাচার্য অবশ্য সে-দিন বলেছিলেন, সুব্রতবাবু ও-কথা বলেননি। মন্ত্রীকে অপদস্থ করার জন্য এ-সব মিথ্যে করে বলা হচ্ছে। আর সাধনবাবুর বক্তব্য সম্পর্কে উপাচার্য শনিবার বলেছিলেন, “আমি ঠিক আছি। পাবলিক এখনও আমাকে চায়।” রবিবার দুই মন্ত্রীর সমালোচনা করে উপাচার্যের পরামর্শ ছিল, রাজনীতিকেরা রাজনীতির কাজ করুন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁদের নাক গলানোর দরকার নেই। এ দিন তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়জোর ২৫ শতাংশ শিক্ষক আমাকে চান না। আর গোটা রাজ্যের শিক্ষক ধরলে সংখ্যাটা টেনেটুনে পাঁচ শতাংশের বেশি হবে না।”
উপাচার্যের এমন দাবি শুনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তম শিক্ষক সংগঠন জুটা-র এক সদস্যের পাল্টা দাবি, প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই যে অভিজিৎবাবুকে চান না, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। সম্প্রতি ছাত্রছাত্রীদের গণভোটে ৯৭ শতাংশ পড়ুয়া উপাচার্যের পদত্যাগের পক্ষে রায় দিয়েছেন। শুধু উপাচার্যের বিরোধিতা করতেই বুধবার সমাবর্তন বয়কট করেছেন ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ। ২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় খুললে পড়ুয়ারা ফের আন্দোলন শুরু করে দেবেন। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে তাঁরা লাগাতার অনশন কর্মসূচিও শুরু করতে পারেন।
এই সার্বিক বিরোধিতার মুখেও তাঁর কি কোনও উদ্বেগ নেই?
“পরিস্থিতি তো প্রায় স্বাভাবিক। না-হলে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা শেষ হল কী করে? এখন যেটুকু খুচখাচ সমস্যা আছে, তা-ও আলোচনায় মিটিয়ে ফেলা যাবে,” দাবি উপাচার্যের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy