Advertisement
E-Paper

ভর্তির জন্য টাকা দিতে হয়েছে সকলকেই, বলছেন পড়ুয়ারা

কারও কাছ থেকে ৪০ হাজার। কেউ বা দিয়েছেন ১ লক্ষ। কারও কাছ থেকে একাধিক ব্যক্তি নিয়েছেন মোট দেড় লক্ষ টাকা। ছাত্র ভর্তি নিয়ে এই দেদার টাকার খেলা প্রকাশ্যে চলে এল চাপড়ার ভক্তবালা বিএড কলেজের অনুমোদন বাতিলের ঘটনায়। নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ৩৯ জন ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করানোর অভিযোগে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় নদিয়ার এই বেসরকারি বিএড কলেজটির অনুমোদন বাতিল করছে বলে উপাচার্য রতনলাল হাংলু জানিয়েছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০৩:৪৬
সাংবাদিক বৈঠকে পার্থ-মুকুল।

সাংবাদিক বৈঠকে পার্থ-মুকুল।

কারও কাছ থেকে ৪০ হাজার। কেউ বা দিয়েছেন ১ লক্ষ। কারও কাছ থেকে একাধিক ব্যক্তি নিয়েছেন মোট দেড় লক্ষ টাকা। ছাত্র ভর্তি নিয়ে এই দেদার টাকার খেলা প্রকাশ্যে চলে এল চাপড়ার ভক্তবালা বিএড কলেজের অনুমোদন বাতিলের ঘটনায়।

নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ৩৯ জন ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করানোর অভিযোগে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় নদিয়ার এই বেসরকারি বিএড কলেজটির অনুমোদন বাতিল করছে বলে উপাচার্য রতনলাল হাংলু জানিয়েছেন। কলেজটির বৈধ একশোটি আসনে ভর্তি হওয়া পড়ুয়ারা এ বার পরীক্ষায় বসতে পারবেন। কিন্তু অতিরিক্ত ৩৯ জনের সেই সম্ভাবনা নেই। হতাশ ওই পড়ুয়াদের অভিযোগ, কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে পর্যন্ত টাকা দিয়ে বিএড-এর আসন কিনেছিলেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সব জানার পরে পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁদের দুই দিকই যেতে বসেছে।

এই ভর্তি কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন ব্যক্তি একে অন্যের দিকে আঙুল তুলছেন। আর তাতেই ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, গোটা বিষয়টিতেই কাজ করেছে বড় একটি চক্র। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ১৭ জন লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, তাঁরা কাকে কত টাকা দিয়েছেন। কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তথা চেয়ারম্যান অমর বিশ্বাস আবার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সম্পাদক, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তন্ময় আচার্যের চাপে অতিরিক্ত ভর্তি নিয়েছিলেন বলে সরাসরি অভিযোগ করছেন। তিনি বলেন, “আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আছেন এর পিছনে।” এমনকী বৈধ একশোটি আসনের মধ্যেও বেশ কয়েকটিতে টাকা নিয়েই ভর্তি করানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এটি ‘সামান্য ঘটনা’ বলেই মনে করছেন। তাঁর মতে, বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। এতে বাইরের ছাত্রছাত্রীদের কাছে রাজ্যের শিক্ষা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমাদের সঙ্গে কথা না বলে উপাচার্য অনুমোদন বাতিল করেন কী ভাবে? উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিবকে সবিস্তার রিপোর্ট দিতে বলেছি। যে-ই জড়িত থাকুক, কেউ ছাড় পাবে না। কিন্তু এক জন যদি অপরাধ করে, সম্পূর্ণ কলেজ শাস্তি পাবে কেন?”

উপাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, ছাত্রদের অভিযোগ পাওয়ার পরেই বিষয়টি উচ্চশিক্ষা দফতরকে জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, “নিয়মের বাইরে বেশি টাকা দিয়ে পড়া বা হিসাব বহির্ভূত টাকা নিয়ে পড়ানোয় কলেজ কর্তৃপক্ষের রাজি হওয়া কোনওটাই সমর্থনযোগ্য নয়। কর্তৃপক্ষকেও প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা নিরপরাধ। তবেই বিশ্ববিদ্যালয় ফের অনুমোদন দেবে।”

২০১২ সালে এনসিটিই’র (ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশন) অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় পার করে চাপড়ার তিলকপুরের ওই কলেজকে ছাত্র ভর্তি নেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছিল কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। এনসিটিই’র নিয়ম অনুযায়ী, বেসরকারি বিএড কলেজগুলিতে একটি শিক্ষাবর্ষে ১০০ জন ছাত্র ভর্তি করানো যায়। এর মধ্যে ৯০ জন কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ও ১০ জন কর্তৃপক্ষের কোটায়। চাপড়ার কলেজটিতে সময় পেরিয়ে যাওয়ায় মাত্র ৭১ জন কাউন্সেলিংয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। অভিযোগ, বাকি আসনগুলিতে শুরু হয় টাকার খেলা। এক লাখ থেকে দেড় লাখ নিয়ে ভর্তি করানো হয়।

কিন্তু সংখ্যাটা একশো পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এর-ওর সুপারিশে চলতে থাকে ভর্তি। এমনকী গত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও তৃণমূলের ছাত্রনেতা তন্ময়ের সুপারিশে এক ছাত্রীকে ভর্তি করানো হয় বলে অভিযোগ। হাজিরা খাতায় কিন্তু নাম তোলা হয়নি অতিরিক্ত পড়ুয়াদের। একটা সাদা কাগজে আলাদা করে হাজিরা নেওয়া হত। এরই মধ্যে ১৩৯ জনেরই ‘প্র্যাকটিস টিচিং’ হয় স্থানীয় ৮টি স্কুলে।

৭ জুলাই বিএডের ফাইনাল পরীক্ষা। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে তার ফর্ম ফিল-আপ পর্ব ঘিরেই।

ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে অতিরিক্ত আসনে ভর্তি হওয়া পড়ুয়ারা দেখেন, তাঁদের রেজিস্ট্রেশন হয়নি এখনও। অথচ কলেজের চেয়ারম্যান এপ্রিল মাসে তাঁদের দু’-দু’বার ডেকে ফর্ম পূরণ করিয়েছিলেন। তার সত্ত্বেও পরীক্ষায় বসা নিয়ে অনিশ্চয়তা জারি থাকায় ওই পড়ুয়ারা প্রথমে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। তার পর বিক্ষোভ দেখান। শেষে গত ৩ জুন কলেজে ভাঙচুর চালান কয়েক জন ছাত্র। শেষমেশ অতিরিক্ত আসনে ভর্তি হওয়া পড়ুয়ারা যোগাযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক বিমলেন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘‘বিষয়টি জানতে পেরে কলেজ কর্তৃপক্ষকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা অন্যায় স্বীকার করেছিলেন। ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে বলে পুরো ঘটনাটি উপাচার্যকে জানিয়েছিলাম।” বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরামর্শে এর পর ওই ছাত্রদের মধ্যে ১৭ জন কাকে-কত টাকা দিয়ে কী ভাবে ভর্তি হয়েছেন, তা লিখিত ভাবে জানান। সেগুলি হাতে পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় সরেজমিন তদন্ত করে। তদন্তে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ৯ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক সুব্রত রায় ওই কলেজের অনুমোদন বাতিল করার নির্দেশ দেন।

কলেজের চেয়ারম্যান অমরবাবুর দাবি, তিনি টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনও তন্ময়রা তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে বলে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, জমা পড়া ১৭টি অভিযোগপত্রে তন্ময় ছাড়াও অনেকের নাম রয়েছে। ধুবুলিয়ার বাসিন্দা এক কলেজপড়ুয়া যেমন অমরবাবুকেই দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, “মহাজনের কাছে চড়া সুদে ঋ

ণ নিয়ে টাকাটা জোগাড় করেছিলাম। এখন তা বেড়ে আড়াই লক্ষ টাকা হয়ে দিয়েছে। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে আমাদের আস্থা আছে।” অমরবাবু অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তন্ময় আচার্যের আবার দাবি, “আমাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে। আমি কাউকে জোর করে ভর্তি করাইনি। টাকাও নিইনি।’’ তন্ময় যুব তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তথা বীজপুরের বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ফলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের পুত্রের দিকেও অভিযোগের আঙুল উঠছে। শুভ্রাংশুর বক্তব্য, ‘‘তন্ময়কে খুব ভাল করেই চিনি। ও তৃণমূল করে। তার মানে এই নয় যে, টাকার বখরা আমি পাব। এগুলো আপনাদের বানানো। সত্যি হলে প্রমাণ করুন। সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করান। টাকাই যদি নেব তবে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব কেন। ’’ আর মুকুলবাবুর মতে, সামগ্রিক ভাবে অন্য রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্যের শিক্ষার অবস্থা ‘একশো গুণ’ ভাল। তাঁর কথায়, “নিশ্চিত ভাবে এ ধরনের ঘটনা অন্যায়। কিন্তু এমন ঘটনা সংবাদমাধ্যম পাঁচ-ছ’টির বেশি দেখাতে পারেনি।

মুকুলবাবুর এই মন্তব্য অবশ্য ভক্তবালা কলেজের ওই ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রহসনের মতো। কেউ কেউ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে আবার নতুন শিক্ষাবর্ষে ওই কলেজে ৩০ জন ভর্তি হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের কী হবে? কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক জানান, উপাচার্য নিজে বিষয়টি দেখছেন। ভবিষ্যতে কী হবে, তিনিই বলবেন।

tmcp chapra bhaktabala bed college mukul roy subhrangsu roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy