Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বিস্ফোরক অঙ্কুর বাউরি

মুখে দায় ঝাড়লেও অস্বস্তি চাপা থাকছে না তৃণমূলে

প্রকাশ্যে দলের জেলা সভাপতি গুরুত্বই দিতে চাইছেন না। অথচ নিজের ‘বিশ্বস্ত’ নেতাকে এলাকায় পাঠাচ্ছেন পরিস্থিতি সামলাতে। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ায় প্রকাশ্য সভায় দলের নেতা অঙ্কুর বাউরির ‘বিস্ফোরক’ বক্তৃতার পরে এখন জেলা তৃণমূলের এমনই ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি দশা’! বৃহস্পতিবার তৃণমূলের এসসি, এসটি, ওবিসি সেলের রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নেতা অঙ্কুরবাবু সংগঠনের জেলা সমাবেশে অনুন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে রঘুনাথপুরের দলীয় বিধায়ক-সহ দলের পদাধিকারীদের একাংশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৩
Share: Save:

প্রকাশ্যে দলের জেলা সভাপতি গুরুত্বই দিতে চাইছেন না। অথচ নিজের ‘বিশ্বস্ত’ নেতাকে এলাকায় পাঠাচ্ছেন পরিস্থিতি সামলাতে।

বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ায় প্রকাশ্য সভায় দলের নেতা অঙ্কুর বাউরির ‘বিস্ফোরক’ বক্তৃতার পরে এখন জেলা তৃণমূলের এমনই ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি দশা’! বৃহস্পতিবার তৃণমূলের এসসি, এসটি, ওবিসি সেলের রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নেতা অঙ্কুরবাবু সংগঠনের জেলা সমাবেশে অনুন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে রঘুনাথপুরের দলীয় বিধায়ক-সহ দলের পদাধিকারীদের একাংশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “যারা লঙ্কায় (ক্ষমতায়) যায়, তারাই রাবণ হয়!” তাঁর অভিযোগ ছিল, জেলায় বিধায়ক, সাংসদ, পঞ্চায়েতসব তৃণমূলের হলেও তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং ওবিসি সম্প্রদায়ের লোকজন বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন পুরুলিয়ায়। প্রকাশ্যে মাইক ধরে অঙ্কুরবাবু এমন সব গুরুতর অভিযোগ তোলায় যারপরনাই অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে ওই সংগঠন তথা তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বকে। এবং ওই ঘটনাকে ধিরে জেলা তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বও আর চাপা থাকছে না।

দলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো শুক্রবার সকালেই তড়িঘড়ি নিজের ঘনিষ্ঠ নেতা নবেন্দু মাহালিকে রঘুনাথপুরে পাঠিয়েছিলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। রঘুনাথপুরে দলীয় কার্যালয়ে এ দিন সকলকে নিয়ে বৈঠকও করেন নবেন্দুবাবু। যদিও প্রকাশ্যে অঙ্কুরবাবুর বক্তব্যকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাইছেন না শান্তিরামবাবু। তাঁর মন্তব্য, “আগেও বলেছি, এখনও বলছি, অঙ্কুর বাউরি আমাদের দলের কেউ নন। ফলে, উনি কী বললেন তা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ আমাদের নেই। আমরা বরং এটাই খতিয়ে দেখছি যে, উনি ওই সংগঠনের সভামঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিলেন কী ভাবে?” জেলা সভাপতি এ কথা বললেও অন্য সুর শোনা গিয়েছে দলের অপর হেভিওয়েট নেতা তথা জেলা কমিটির প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। তাঁর কথায়, “অঙ্কুর বাউরিদের মতো পুরনো কর্মীরা কেন প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলছেন, তা দলীয় স্তরে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখা হবে।”

অর্থাৎ, জেলা সভাপতি যাঁকে বলছেন দলের কেউ নন, তাঁকেই আর এক নেতা অভিহিত করছেন দলের পুরনো কর্মী হিসাবে! দলের ভিতরকার দ্বন্দ্বটা চাপা থাকছে না। জেলা তৃণমূলের দুই শীর্ষ নেতার পরস্পর-বিরোধী মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দলে নতুন ও পুরনোদের চিরন্তন দ্বন্দ্বটাও। এ দিন অঙ্কুরবাবুর ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

জেলা তৃণমূলের একাংশ মনে করছে, বৃহস্পতিবারের সভায় অঙ্কুর বাউরি মুখে বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও তাঁর মূল নিশানা ছিলেন রঘুনাথপুর ১ ব্লকের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দাপুটে নেতা প্রদীপ মাজি। এবং প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী একাধিক অভিযোগ তুলে সরব হলেও রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরির ‘প্রচ্ছন্ন সমর্থন’ প্রদীপবাবুর প্রতি থাকায় আখেরে অঙ্কুরবাবুর মতো নেতাদের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে বিধায়কের বিরুদ্ধেই। বৃহস্পতিবার কিন্তু বিধায়ক ছাড়াও অঙ্কুর বাউরি দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে তুলোধনা করেছেন প্রদীপ মাজিকেও। সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অঙ্কুরবাবু প্রকাশ্যেই বলেন, “দলে প্রদীপ মাজির মতো নেতারা নিজেদের আখের গোছানোর স্বার্থে, লুটেপুটে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন পঞ্চায়েতে সৎ প্রধানদের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একই ঘটনা ঘটছে পঞ্চায়েত সমিতিতেও।”

শুধু তাই নয় প্রদীপবাবুকে রঘুনাথপুর ১ ব্লকে দলের দায়িত্ব দেওয়া প্রসঙ্গেও ক্ষোভ প্রকাশ করে অঙ্কুরবাবুর মন্তব্য ছিল, “চা-বেগুনির দোকানে বসে দলীয় প্যাডে লিখে দিলাম ইনি সভাপতি, উনি কাযর্করী সভাপতি। এটা মানি না। এ ভাবে পার্টিতে বেনোজল ঢুকে যাচ্ছে। আর সেই সব লোক লঙ্কায় মানে প্রদেশে চলে গিয়ে আমাদের মতো পুরনো কর্মীদের ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে!” অঙ্কুরবাবুর অভিযোগের মন্তব্য করতে চাননি প্রদীপবাবু। বলেছেন, “যা বলার দলের জেলা সভাপতি বলবেন।” মন্তব্যে নারাজ বিধায়কও।

রঘুনাথপুরের তৃণমূল কর্মীদের বড় অংশ মনে করছেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দলকে। বিভিন্ন পঞ্চায়েতে অনাস্থা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সমিতিতেও অনাস্থা, সব ক্ষেত্রেই মুখ পুড়েছে । আর অঙ্কুরবাবুর মতো পুরনো তৃণমূল নেতার মন্তব্য সেই দ্বন্দ্বকে একেবারে কাছাখোলা করে দিয়েছে। বস্তুত, অঙ্কুরবাবু নিজেও এই অনাস্থার প্রসঙ্গ তুলে বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, “প্রতিটা অঞ্চলে (রঘুনাথপুর ১ ব্লকের) অনাস্থা হচ্ছে. পঞ্চায়েত সমিতিতে অনাস্থা হচ্ছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে বলেই এ সব হচ্ছে!”

এই অবস্থায় জেলা সভাপতির নির্দেশে রঘুনাথপুর ১ ব্লকে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এ শুক্রবার রঘুনাথপুরে আসেন নবেন্দু মাহালি। এ দিন শুধু দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আলোচনাই নয়, ব্লকের প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গেও উন্নয়নের কাজে স্বচ্ছতা রাখার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন নবেন্দুবাবু। বিশেষ করে নিজেদের দখলে থাকা পঞ্চায়েত সমিতিতে ঠিকাদারি নিয়েও আলোচনা করেছেন ওই তৃণমূল নেতা। পরে তিনি বলেন, “জরুরি ভিত্তিতে রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, পঞ্চায়েতগুলির প্রধান এবং নেতা-কর্মীদের নিয়ে ব্লকের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়ণের আগে দলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তার রূপরেখা ঠিক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

raghunathpur tmc ankur bauri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE