ছেলে হবে, না মেয়ে?
এ সব নিয়ে ভাবেইনি লোকটা। কিন্তু যে আসছে ওরই ছায়া হবে ঠিক! পেটেই যা লাথালাথি, দুষ্টুমি দিন-রাত...
মাটির দাওয়ায় সাবধানে পা ছড়িয়ে বসছেন হবু মা। বাঁ হাতটা পেটে ছুঁইয়ে স্মিত মুখে শুনছেন অনাগতের আগমনী! ডান হাতে কোলের কাছে ধরা সদ্য বাঁধানো একটি ফটোগ্রাফ। তাতে কদমছাঁট চুল, টাইট গেঞ্জির সুঠাম যুবক। মামাতো দেওরের মোবাইল থেকে ছবিটা নিয়ে কান্দির স্টুডিওতে নিজেই বাঁধিয়ে এনেছেন নববধূ।
অদূরে বসে থাকা শ্বশুর-শাশুড়ির উপস্থিতি ভুলে আলতো হেসে ফেলছেন বছর বাইশের শ্রাবণী ঘোষ। বলে উঠছেন, “উফ্ যা করত লোকটা! এই এক হাতে, না-না ধরুন, এক আঙুলেই ফট করে তুলে ফেলত আমায়। ভয় দেখাত, দেখবা তোমাকে কোলে করে কলকাতা নিয়ে চলে যাব। তোমার যা ওজন, আমি কোলে করেই হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে যেতে পারি!”
এখন মনে হয় নিয়ে গেলেই হয়তো ভাল ছিল। আরও ক’টা দিন কাছাকাছি থাকা যেত। মহারাষ্ট্রের ভাণ্ডারা বা ছত্তীসগঢ়ের দান্তেওয়াড়ার নাম সেই প্রথম শোনা। “আমি তো জানতাম সিআরপি-র চাকরি, মানে রিস্কের কাজ। ওকে ফোনেও বলতাম, তুমি যেন কোথাও আগে যাবা
না! সাবধানে থাকবা! তবু ও তো ডনের মতো ছিল...কী করে বিশ্বাস হবে বলুন?”
পঁচিশ বছরের কোবরা জওয়ান চন্দ্রকান্ত ঘোষ নিজেও কি বিশ্বাস করেছিলেন? সবে ঘরে আনা স্ত্রীকে বলতেন, “আমার বুকে দু-চারটা গুলি ড্রপ খেয়ে চলে যাবে, বুঝলা!”
দুই ভাই সূর্যকান্ত আর রাখহরি শুনে হাসত, তা-ই বটে! দাদাকে এক জন ডব্লিউডব্লিউএফ ফাইটারের মতো লাগত।
বিয়ের কুড়ি দিনের মাথায় ডিউটিতে ফিরেই মহারাষ্ট্র থেকে দান্তেওয়াড়ায় যেতে হল। তখন লোকসভা ভোট। মা জ্যোৎস্না বারবার বলতেন, “তুমি কিন্তু সকাল-বিকাল দু’বার করে ফোন করবা চাঁদ। শুধু কেমন আছ, বললেই হবে!” ফোন করার বড় কষ্ট দান্তেওয়াড়ায়। “ও বলল, তুমি কি চাও আমার অসুবিধা হোক! ফোন রেখে দিল।”
পরের দিন সকালেই ভোট করানোর বাবুদের বুথে পৌঁছে দিতে হবে! তারপর সবার আগে বুক চিতিয়েই ফিরছিলেন চাঁদ, সুকনার চিন্তাগুফায়। পিছন থেকে হঠাৎ ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি। সত্যিই দু-একটা নয়, জঙ্গিদের দশ-বারোটা গুলি খরচ হয়েছিল চন্দ্রকান্তের জন্য...
তার ক’দিন আগেই সুখবরটা দিয়েছিলেন শ্রাবণী। ফোনে শুনেই ভারী ব্যস্ত হবু বাবা। “ও বলল, মাকে ফোনটা দাও! মাকে বলে তোমার বউমাকে দই দিবা, ডিম দিবা— সকালে একটা, বিকালে একটা! আর বাদাম ভিজানো খাওয়াবা!” জামাইষষ্ঠীতে ঘরে এলে, কেশরটা নিজেই আনবে বলেছিল। সে আর হল কই! এখন দাদার কথা রাখতে দুই ভাই কান্দিতে অনেক খুঁজে এক গ্রাম কেশর জোগাড় করে বৌদিকে খাইয়েছে।
ইদানীং কিছুই মুখে রোচে না শ্রাবণীর। তবু খেতে হয়। আর মোটে ক’দিন...!
গেল পুজোতেও এমনই অপেক্ষা ছিল। বিএ পাশ করে এমএ-তে ভর্তির কথা ভেবেছিলেন শ্রাবণী। চন্দ্রকান্ত দেখতে আসতেই মোড় ঘুরে যায়। “ও মজা করে বলল, কী আমায় পছন্দ হয়নি? তাই কথা বলছ না?” পুজোর আগেই সব ঠিকঠাক। ভাইদের টাকা পাঠিয়ে একটা সিল্কের ভাল শাড়ি কিনে দিলেন হবু স্বামী। “মা পরিয়ে দিল, কান্দির অরবিন্দ স্পোর্টিং, ইন্দ্রতলা ঘুরে এলাম! ভাবছিলাম, পরের বার বিয়ের পর প্রথম পুজো— ও নিশ্চয়ই আসবে! একসঙ্গে ঘুরতে যাব আমরা।”
পাড়াগেঁয়ে দাওয়া ঘিরে আচমকা শরতের বৃষ্টি। বৃষ্টির মতোই মুখে খই ফুটছে তরুণীর। “ও থাকলে, এ পুজোয় দু’টো বাড়িতেই দেওয়া-থোওয়ার ধুম লাগত। এক সঙ্গে তিনটে-চারটে কাপড় হতো সবার।” এখন ভাবলে সব কিছুই রগড় বলে মনে হয়!
মাটির ঘরের পাশে থমকে থাকা ইঁটের গাঁথনি দেওয়া পাকা ঘরটাও মস্ত রগড়! এত দিনে রং হওয়ার কথা ছিল। বুড়ো মা-বাপের কষ্ট ঘোচাবেন বলে পাকা ঘরটা যিনি তুলছিলেন, সেই মানুষ কই!
পাকা-বাড়ির একটা ঘরেই নবদম্পতির বিয়ের খাট, যৌতুকের আলমারি, শো-কেস, আলনা। আলমারির মাথায় বর-বউয়ের টোপর, মুকুট। ছড়ানো-ছিটোন বিয়ের যত রাজ্যের উপহার, নতুন ঘড়ি, গন্ধতেল। বরের দেওয়া সুগন্ধীর গায়ে লেখা ড্রিমগার্ল। পাশেই রাখা লিভার টনিক, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট। মৃত্যু না জন্ম, কোনটা সত্য গুলিয়ে যায় প্রসূতি নারীর।
এই ঘরটাতেই শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে রাতে ঘুমোন বৌমা। সালওয়ার কামিজ পরে কান্দিতে ডাক্তার দেখাতে যান। “গ্রামের লোকে কী বলল, কিচ্ছু আসে যায় না! এখানে আমি মেয়ের মতোই থাকি।”
বহরমপুরের রাস্তায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মাহাদিয়া। শ্রাবণীর বাপের বাড়ি। মা সম্মানীর চোখ ছলছল করে, “মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসতেই চায় না! বরকে ভুলতে পারেনি একটুও!”
কুড়ি দিনের দাম্পত্যের চিহ্ন বিয়ের ছবি প্লাস্টিকের প্যাকেট খুলে ঘাঁটেন নববধূ। আনমনে বলেন, “ছেলেই হোক বা মেয়ে— ভাল করে লেখাপড়া শিখাব! ও বলত, আমার সন্তান ডাক্তার হবে। লোকে বলবে, ডাক্তারের বাবা চন্দ্রকান্ত!”
শুনে শাশুড়ি মা চোখ তুলে তাকান। ডাক্তারই ভাল! নয়তো যা হোক কিছু! কিন্তু এই মারামারি-কাটাকাটি মায়ের কোল খালি করা চাকরি ভাল নয় ঠাকুর! শহিদের বাবা মহাদেবের গলা কাঁপে, “চাঁদ বলত আমার জন্য গর্ব করবা, দেশের কাজ করতে গেছি! আমি ভাবি, কার কাজে লাগল জোয়ান ছেলেটা?”
কোনও নেতা-মন্ত্রীর পায়ের ধুলো পড়েনি হতদরিদ্র ঘরে। পেনশন, ক্ষতিপূরণের টাকার বারো আনাই আসতে বাকি। সরকারি চাকরির আশায় তাকিয়ে বেকার ভাইরাও!
শ্রাবণী বলেন, “কী ভাবে গ্রামে ওর একটা স্ট্যাচু বসাতে পারি, বলতে পারেন? যে আসছে, তাকে দেখিয়ে বলব ওই তোর বাবা!”
প্রাণের স্পন্দন নড়ে-চড়ে তরুণীর ভিতরে। বুকের গভীরে অন্য এক প্রতিমার বোধন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy