ছবিতে মালা এবং ফুল দেওয়া সবে শেষ হয়েছে। অতিথিরা আসন খুঁজে বসেছেন। মাইক্রোফোনের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বভাবসিদ্ধ আত্মবিশ্বাসে স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর বহুমুখী প্রতিভার প্রশংসা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার মধ্যেই বললেন, “স্বাধীন ভারতকে গড়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। ওঁর লেখা ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ পড়ে ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। আমিও জেনেছি।”
বিধানসভার লবিতে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের চোখ তখন আরও গোল গোল হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মাথা নিচু। মধ্যরাতে স্বাধীনতা নিয়ে মধ্যদুুপুরে ভুলটা শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হল। ভাষণ দিতে গিয়ে ভাব-গাম্ভীর্য রেখেই বিরোধী দলনেতা উল্লেখ করলেন, নেহরুর বইটার নাম আসলে ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’। কন্যা ইন্দিরাকে তাঁর পত্র সংকলনও খুবই আকর্ষণীয়। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর মৃত্যুর পরে ‘লাইট হ্যাজ গন আউট অব আওয়ার লাইভস’ মন্তব্যটিও বিখ্যাত। আর স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে জাতির উদ্দেশে নেহরুর ভাষণে মধ্যরাতে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ছিল। সেই ভাষণও ঐতিহাসিক।
সূর্যবাবু সরাসরি বলেননি ঠিকই। কিন্তু কৌশলে তাঁর ভুল শুধরে দেওয়ার পরেই অনুষ্ঠান শেষে বিধানসভার লবিতে হাসির রোল। তত ক্ষণে সকলে বুঝে নিয়েছেন, ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ নামে কোনও বই নেহরু লেখেননি। ওই নামে বই অবশ্য আছে। তার লেখক দমিনিক ল্যাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্স। লবিতে দাঁড়িয়েই এক কংগ্রেস বিধায়কের সহাস্য মন্তব্য, “সনিয়া গাঁধীর আগে নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে আবার নতুন বই না আবিষ্কার করে ফেলেন!” পাশ দিয়ে যেতে যেতে কৌতুকের হাসি খেলে গেল এক মন্ত্রীর মুখেও। বিধানসভায় শুক্রবার এমনই নানা কৌতুকের মণিমুক্তো ছড়িয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। কখনও নেহরুর নতুন বই খুঁজে পেলেন। কখনও কুণাল ঘোষের শারীরিক অবস্থার খবর দিতে গিয়ে বললেন, তাঁর নাড়ির গতি ৪৪ হয়ে যায় কখনও সখনও! কখনও ডক্টরেট তরুণ নস্করকে ডাক্তার ভেবে বসলেন। মাদ্রাসা এবং জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে গুরুতর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ফাঁকেই মন্তব্য করলেন, “মিডিয়ায় এখন আরশোলা মরলে, টিকটিকি বেরোলেও বড় খবর!”
বিরোধীদের সমালোচনার জবাব দেবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করেছিলেন, এ সপ্তাহে তাঁর নির্দিষ্ট দিনে বিধানসভায় এসে দেখিয়ে দেবেন! অধিবেশন কক্ষের ফটক খোলার আগেই এ দিন হাজির হয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর থেকেই দিনভর উদ্ভট সব কাণ্ড! চার পাশে এত ঘটনা। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে-থাকা স্বরাষ্ট্র দফতর নিয়ে কোনও প্রশ্নই নেই তালিকায়! বিরোধী দলনেতা খাগড়াগড়-কাণ্ড, নারী নির্যাতন, সিভিক পুলিশ থেকে শিল্পের জন্য জমিব্যাঙ্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছিলেন। সবই মুখ্যমন্ত্রীর আওতাধীন। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন ‘খুবই বিভ্রান্তিকর’ বলে বাতিল করে দিয়েছেন স্পিকার। হতবাক এবং ক্ষুব্ধ বামেরা ওয়াক আউট করে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁকে ‘ফেস করার সাহস’ নেই বলে বামেদের অনুপস্থিতিতে তাদের কটাক্ষ করে এর পরে কী করলেন মুখ্যমন্ত্রী? প্রশ্নোত্তর-পর্বে কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প নিয়ে নানা কথা বলে ৩৫ মিনিট কাটিয়ে দিলেন। তার মধ্যেও বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশের যন্ত্রচালিত তাঁতের শাড়ি সীমান্ত পেরিয়ে এ রাজ্যের বাজার নিচ্ছে। সরকার কী করছে? মুখ্যমন্ত্রী চাল বসালে তবে ভাত হয় বলে এমন বাক্বিস্তার করলেন, শাসক বেঞ্চের আলাপচারিতেও হাহুতাশ শোনা গেল!
এসইউসি-র তরুণবাবু আবার জানতে চেয়েছিলেন, বর্ধমানের ঘটনার পরে কত অননুমোদিত মাদ্রাসায় তল্লাশি চালিয়ে কত জঙ্গির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে? কারণ, এই ঘটনাকে নিয়ে প্রচার চলছে যেন, অননুমোদিত মাদ্রাসা মানেই জঙ্গি-ঘাঁটি! মুখ্যমন্ত্রীর জবাবে নির্দিষ্ট তথ্য তরুণবাবু পেলেন না। উল্টে ‘ধর্মগুরু বলতাম আগে, এখন এসেছে দাঙ্গাগুরু’ জাতীয় মন্তব্য-সহ এমন জায়গায় শেষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী, যাতে মনে হয় তরুণবাবু আসলে বিজেপি-রই লোক! পাশাপাশি আসনে বসা শমীক আর তরুণবাবু সহাস্যে বিস্ময় বিনিময় করলেন! সকৌতুক আর সবিস্ময় দিন কাটল বিধানসভারও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy