Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রাতবিরেতে কড়া নাড়ছে সিট, আতঙ্কে সাগর ঘোষের পরিবার

রাতবিরেতে দরজায় খটখট। দিনের পর দিন সেই একই জেরা। সঙ্গে থাকে না মহিলা পুলিশও। প্রায় বিনা নোটিসেই খুনের তদন্তে সময়ে-অসময়ে ‘স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম’-এর (সিট) চলে আসা নিয়ে তাই ক্ষোভ দানা বাঁধছিল বীরভূমের পাড়ুইয়ে নিহত সাগর ঘোষের পরিবারে। রবিবার রাতে সাগর ঘোষের বাড়িতে আসা সদস্যদের ফিরিয়ে দেওয়া, সেই ক্ষোভেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের অভিযোগ, তাঁরা যাবতীয় সহযোগিতা করলেও অভিযুক্তদের না ধরে তদন্তের নামে পুলিশ আসলে তাঁর পরিবারকেই হেনস্থা করছে।

ঘোষ বাড়িতে সিটের প্রতিনিধিরা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

ঘোষ বাড়িতে সিটের প্রতিনিধিরা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০২
Share: Save:

রাতবিরেতে দরজায় খটখট। দিনের পর দিন সেই একই জেরা। সঙ্গে থাকে না মহিলা পুলিশও।

প্রায় বিনা নোটিসেই খুনের তদন্তে সময়ে-অসময়ে ‘স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম’-এর (সিট) চলে আসা নিয়ে তাই ক্ষোভ দানা বাঁধছিল বীরভূমের পাড়ুইয়ে নিহত সাগর ঘোষের পরিবারে। রবিবার রাতে সাগর ঘোষের বাড়িতে আসা সদস্যদের ফিরিয়ে দেওয়া, সেই ক্ষোভেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের অভিযোগ, তাঁরা যাবতীয় সহযোগিতা করলেও অভিযুক্তদের না ধরে তদন্তের নামে পুলিশ আসলে তাঁর পরিবারকেই হেনস্থা করছে। হৃদয়বাবুর ক্ষোভ, “বাড়িতে বৃদ্ধা মা হৃদ্রোগে আক্রান্ত। স্ত্রীও অসুস্থ। এই অবস্থায় ওঁরা রবিবার রাত ১১টা নাগাদ তদন্তে আসেন। আমরা গোটা ব্যাপারটায় বিরক্ত, বিধ্বস্ত। এ ভাবে মাঝরাতে তদন্তের নামে ওঁরা ঠিক কী করতে এসেছিলেন, তা ওঁরাই ভাল বলতে পারবেন!”

খুনের মামলার অভিযোগকারিণী, সাগরবাবুর পুত্রবধূ শিবানীদেবী বলেন, “প্রায়ই রাতে বাড়িতে পুলিশ ঢুকছে। অথচ সঙ্গে মহিলা পুলিশ থাকছে না। আমরা ঘরের মেয়েরা তাতে যথেষ্টই আতঙ্কিত হচ্ছি।” বীরভূম জেলা পুলিশের কর্তাদের একাংশ বলছেন, এ সব ক্ষেত্রে তদন্তে গেলে (বিশেষ করে সন্ধ্যায় বা রাতে) সঙ্গে মহিলা পুলিশকর্মী থাকলে ভাল হয়। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে কোনও মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে তাঁকে যেমন থানায় ডেকে পাঠানো যায় না, তেমনই তাঁর বাড়িতে যেতে হলে, মহিলা পুলিশ থাকতেই হবে। না হলে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের কোনও অফিসার থাকা আবশ্যক।” তাঁর সংযোজন, মহিলার মনে যাতে ভয়ের সঞ্চার না হয়, তার জন্য পুলিশকে সাদা পোশাকে থাকতে হবে। এ সব নিয়ম মানা না হলে যাঁর নির্দেশে তদন্তদল গঠিত হয়েছে, তাঁকে সব জানাতে হবে।

ঘটনা হল, সিট-এ কোনও ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের অফিসার নেই। দলে রয়েছেন কেবল পুলিশ আধিকারিকেরা। মহিলা পুলিশ না থাকা প্রসঙ্গে বীরভূমের পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খানের মন্তব্য, “এ কথা আমাকে কেন, সিট-কেই জিজ্ঞেস করুন।” সিট-এর সদস্যদের অবশ্য মুখে কুলুপ! সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নেরই তাঁরা উত্তর দিচ্ছেন না।

সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় মূল অভিযুক্তদের (তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, বীরভূমের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী) কাউকে গ্রেফতার না করায় নিহত সাগরবাবুর পরিবার আরও হতাশ। পাশাপাশি রবিবার অত রাতে যে সিট আসবে, তা তাঁদের আগাম জানানো হয়নি বলেও হৃদয়বাবুদের দাবি। সিট-এর সঙ্গে ছিলেন পাড়ুই থানার ওসি নীলোৎপল মিশ্র। হৃদয়বাবু জেগে থাকলেও ঘরের ভিতরে তখন ঘুমিয়ে সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী ও পুত্রবধূ শিবানী ঘোষ। এত রাতে তদন্তে আসতে দেখে হৃদয়বাবু ক্ষোভে ফেটে পড়েন। দরজা খুলে ভিতর থেকেই বিশেষ তদন্তকারী দলের উদ্দেশে তাঁকে বলতে শোনা গেল, “আর কত তদন্ত করবেন? কেন এসেছেন মাঝরাতে? আপনাদের তদন্তে আমাদের আর আস্থা নেই।”

তদন্তকারীরা তত ক্ষণে বাড়ির উঠোনে ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন। এমনকী দু’একজন বাড়ির দোতলার ঘরেও পৌঁছে যান। হৃদয়বাবু চেঁচিয়ে ওঠেন, “হয় আসল অপরাধীদের গ্রেফতার করুন। তা না পারলে, আমাদের সবাইকে গুলি করে মারুন! সুবিচারের আশায় এ ভাবে তিলে তিলে মরার থেকে একেবারে মরে যাওয়াই ভাল!” পরিবারের তীব্র ক্ষোভের আঁচ পেয়ে তদন্তের কাজ গুটিয়ে নেয় সিট। “বাবার খুনের তদন্ত দেখছি, প্রহসনে পরিণত হয়েছে।”হতাশা ঝরে পড়ে হৃদয়বাবুর গলায়।

এলাকায় তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর (অনুব্রত-শিবিরের বিরোধী) নেতা-কর্মীরাও সিট-এর ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। তাঁদের বক্তব্য, গত আট মাস ধরে সাগরবাবুর খুনের তদন্ত একচুলও এগোয়নি। মূল অভিযুক্তেরা ধরা পড়েনি, উদ্ধার হয়নি খুনে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রও। অথচ তদন্তের নামে যখনতখন বাড়িতে এসে ওই পরিবারটির উপরে ‘চাপ’ সৃষ্টি করা হচ্ছে। স্থানীয় কসবা অঞ্চলের বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা নিখিল পালের প্রশ্ন, “বারবার সেই একই কথা আর কত বার তদন্তকারীদের সামনে হৃদয়বাবুদের বলতে হবে?” আর এক নেতা নারায়ণচন্দ্র ভাণ্ডারীও বলেন, “তদন্তের নামে হেনস্থা করা হচ্ছে।”

সোমবারই বোলপুরে দলীয় প্রার্থীর প্রচারে এসে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও অভিযোগ করেন, “নবান্ন থেকে যে ধরনের নির্দেশ পায়, সে ভাবেই সিট কাজ করে। ওঁদের কাজ হৃদয়দের বাঁচানো নয়, আসামিদের বাঁচানো!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sagar ghosh hriday ghosh mahendra jena parui
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE