Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শুধুই সারদায় বিঁধে জেতা চাপ, মত বিজেপি কর্মীদের

তৃণমূল তখন জোরদার প্রচার করে ফাটিয়ে দিচ্ছে এলাকা। এ দিকে, বাগদা-গাইঘাটার গ্রামীণ এলাকায় তখনও চোখেই পড়ছে না বিজেপির পতাকা-ফেস্টুন। প্রচারের এই হাল দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই। কারণ, দলের ঊর্ধ্বতন নেতারাই এ বার ভোটের হাল ধরেছেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তুলনায় ব্যাকফুটে। কিন্তু না আসছে টাকা, না আসছে ভোট-প্রচারের সরঞ্জাম। কে কোথায় কী ভাবে প্রচার করবেন, তার কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশও নেই।

গম্ভীর মুখে চায়ে চুমুক সুব্রতর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

গম্ভীর মুখে চায়ে চুমুক সুব্রতর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র ও অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:৪৬
Share: Save:

তৃণমূল তখন জোরদার প্রচার করে ফাটিয়ে দিচ্ছে এলাকা। এ দিকে, বাগদা-গাইঘাটার গ্রামীণ এলাকায় তখনও চোখেই পড়ছে না বিজেপির পতাকা-ফেস্টুন। প্রচারের এই হাল দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই। কারণ, দলের ঊর্ধ্বতন নেতারাই এ বার ভোটের হাল ধরেছেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তুলনায় ব্যাকফুটে। কিন্তু না আসছে টাকা, না আসছে ভোট-প্রচারের সরঞ্জাম। কে কোথায় কী ভাবে প্রচার করবেন, তার কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশও নেই। সব মিলিয়ে খানিকটা যেন দিশাহারা ভাব। দলের হোমরাচোমরা নেতারা এসে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। বলছেন, “ভাগ মুকুল ভাগ, ভাগ মমতা ভাগ।” তাতে উপচে পড়া ভিড়টা হাততালি দিচ্ছে। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস ইভিএম অব্দি পৌঁছবে কিনা, তখনই প্রমাদ গুণছিলেন স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরা। স্বরূপনগরে তো দলের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহকে ঘিরে যে কারণে বিক্ষোভও দেখান তাঁদের অনেকে।

কিন্তু বনগাঁয় ভোটের ফল প্রকাশের পরে চওড়া হাসি বিজেপি নেতাদের মুখে। ৬ শতাংশেরও বেশি ভোট বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। নেতাদের মতে, বামেদের ক্রমবর্ধমান রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকায় এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে আগামী দিনে তারাই যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে চলেছে, সেই প্রমাণও রেখে গেল গেরুয়া শিবির।

বনগাঁ কেন্দ্রে উপনির্বাচনে বিজেপি অবশ্য তৃতীয় স্থানে দৌড় শেষ করেছে। কিন্তু গতবারের থেকে তাদের প্রাপ্ত ভোট বেড়েছে অনেকটাই। ২০১৪ সালে কেডি বিশ্বাসকে প্রার্থী করে যে লড়াই তারা দিয়েছিল এই আসনে, তাতে ভোট পেয়েছিল ১৯.২১ শতাংশ। এ বার সুব্রত ঠাকুরকে সামনে রেখে বিজেপি পেয়েছ ২৫.৪১ শতাংশ ভোট। স্বভাবতই এই ফলে উজ্জীবিত বিজেপি শিবির। দলের বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “আমার বিশ্বাস ছিল, আরও ভাল ফল হবে। তবে তবে যেটা হয়েছে, সেটাও যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। সিপিএম এ রাজ্যে এখন কাগজে-কলমে বিরোধী হয়ে থেকে গিয়েছে। পরিবর্তনের মধ্যেও পরিবর্তন যে বিজেপিই আনতে পারে, এই ফলাফল সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।”

বিজেপিকে অবশ্য শুরুর দিকে বেশ ভুগিয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সুব্রত ঠাকুর ও তাঁর বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে সুব্রতকেই প্রার্থী ঘোষণা করে বিজেপি। কিন্তু সুব্রতর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন ছিল বিস্তর। বয়সে নবীন সুব্রত পড়াশোনা, চাকরির সূত্রে অনেকটা সময় থেকেছেন বাড়ির বাইরে। ফিরে আসার পরে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তৃণমূলের টিকিটে জিতে গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য হয়েছেন ঠিকই কিন্তু, এলাকায় তাঁর জনসংযোগ কম, সে কথা মানেন দলের নেতা-কর্মীরাও। সেই সুব্রত স্রেফ ভোটের টিকিট পাওয়ার জন্যই দল বদল করলেন বলেও অভিযোগ তোলে তৃণমূল। সেই অভিযোগে সারবত্তা খুঁজে পেয়েছে বিজেপিরও একাংশ।

প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় বারাসতে দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান কর্মীরা। সুব্রতকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করার দিনই গাইঘাটায় রেল অবরোধ করেন দলের কিছু কর্মী-সমর্থক। তাঁদের কাছে আগের বারের প্রার্থী কেডি বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেকটাই বেশি। সেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিজেপি। বনগাঁয় কর্মিসভায় এসে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ সুব্রত ও কেডিকে দু’পাশে বসিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন।

যে বার্তা পরে শোনা গিয়েছে কেডির মুখেও। ভোটের প্রচারে বেরিয়ে সভায় কেডি কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, “আমার কিছু দুঃখ-যন্ত্রণা আছে। আপনাদেরও আছে। কিন্তু কে প্রার্থী হলেন, সেটা বড় কথা নয়।”

কিন্তু কেডির এই বক্তব্য সত্ত্বেও অবশ্য সমস্যা পুরোপুরি এড়ানো যায়নি। দলের প্রবীণ নেতা কিশোর বিশ্বাস প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় নির্দল হিসাবে মনোনয়ন জমা দেন। তার মান ভাঙিয়ে কাছে টানার কোনও চেষ্টা তো দেখাই যায়নি, বরং দল থেকে হঠাৎই বহিষ্কার করা হয়েছে তাঁকে। ১,৯৮৬টি ভোট পেয়ে কিশোরবাবু অবশ্য তেমন কোনও দাগ কাটতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু দলের কাছে ভুল বার্তা গিয়েছে বলে মনে করেন নিচুতলার বহু কর্মী।

ঐক্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা উপর মহলে থাকলেও সত্ত্বেও প্রচারে যে শেষবেলা পর্যন্ত খামতি থেকে গিয়েছে, সে কথা এখন বলছেন দলের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় নেতাদের ভিড়ে তাঁদের দায়িত্ব কী হবে, সে দিকেই নজর দেওয়া হয়নি। কে কোথায় কী ভাবে প্রচার করবেন, তা নিয়ে দলের তরফে সুস্পষ্ট বার্তার অভাব ছিল বলেও তাঁদের মত। বনগাঁর এক বিজেপি নেতার কথায়, “সময় মতো প্রচারের সরঞ্জাম পাইনি। টাকার অভাব ছিল। পরিকল্পনারও অভাব ছিল। শুধু বাইরে থেকে এসে বড় বড় ভাষণ দিয়ে গেলেই তো হল না। নিচু তলায় সংগঠনও তো চাঙ্গা করতে হবে।”


স্বামীর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা মমতার। ছবি: শান্তনু হালদার।

কাজেই দলের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেরই মতে, বামেদের ভোটের বড় অংশ তাদের পক্ষে যদি এসেও থাকে, তার কৃতিত্ব চাওয়াটা সংগঠনের শক্তি-সামর্থের নিরিখে খুব একটা উচিত হবে না।

তবে সুব্রত-মঞ্জুলরা তেমনটা মনে করছেন না। তৃতীয় স্থানে থেকে দৌড় শেষ করেও সুব্রতর বক্তব্য, “ভোটের এই ফল কিছু নতুন সমীকরণ রেখে গেল। বিরোধী শক্তি হিসাবে বিজেপি যে উঠে আসছে, তা-ই প্রমাণ হয়ে গেল।” কী বলছেন মঞ্জুল? তাঁরও বক্তব্য, “ফল ভালই হয়েছে। মতুয়ারা আমাদের পক্ষে ছিলেন।” বিজেপির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হালদার বলেন, “সব কর্মীকে শেষ মুহূর্তে প্রচারে নামানো গিয়েছিল। বাবুল সুপ্রিয়, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, কুমার শানুর মতো অনেক তারকা প্রচারে এসেছেন। তাতে যা ফল মিলেছে, বহু মানুষের সমর্থন পেয়েছি আমরা।”

তবে দলের স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরা অন্য সুরেই কথা বলছেন। তাঁদের অনেকের মতে, সংগঠন বাড়ানোয় জোর না দিলে শুধু সারদা সারদা করে কিংবা সিপিএমের ভোট ভাঙার ভরসায় থেকে তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দেওয়া মুশকিল। আর কেডি বিশ্বাস তো সরাসরি বললেন, “দলের ক্ষতিই হয়েছে এই ফলে। সাংগঠনিক দুর্বলতা পুরোপুরি ঢাকা যায়নি।” কিন্তু সুব্রতর জায়গায় অন্য কেউ প্রার্থী হলে কি ফল আরও ভাল হতে পারত? কেডি অবশ্য এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বলেন, “যা বলার মানুষই বলবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE