Advertisement
০৫ মে ২০২৪
বিচারককে হুঁশিয়ারি আইনজীবীর

শুনানির মধ্যেই ফোন কানে মন্ত্রী মদন

কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে সাংসদের চড়, রাতদুপুরে ডেপুটি স্পিকারের কলকাতা থেকে হাওড়া গিয়ে এক চিকিৎসকের সঙ্গে বচসায় জড়ানো, থানায় চড়াও হয়ে পুলিশ নিগ্রহ— নৈরাজ্য সৃষ্টির নানা অভিযোগ নিয়মিতই ওঠে ছোট-বড় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রশাসন ঠুঁটো হয়ে থেকেছে। শুক্রবার এক ধাপ এগিয়ে আদালত কক্ষেও তাঁদের মার্কামারা নৈরাজ্যের স্রোত বইয়ে দিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের অনুগামীরা। এমনকী বিচারককে পর্যন্ত হুমকি দিলেন তৃণমূলের এক আইনজীবী।

স্লোগান দিতে দিতেই আদালতে ঢুকলেন মদন। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

স্লোগান দিতে দিতেই আদালতে ঢুকলেন মদন। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে সাংসদের চড়, রাতদুপুরে ডেপুটি স্পিকারের কলকাতা থেকে হাওড়া গিয়ে এক চিকিৎসকের সঙ্গে বচসায় জড়ানো, থানায় চড়াও হয়ে পুলিশ নিগ্রহ— নৈরাজ্য সৃষ্টির নানা অভিযোগ নিয়মিতই ওঠে ছোট-বড় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রশাসন ঠুঁটো হয়ে থেকেছে। শুক্রবার এক ধাপ এগিয়ে আদালত কক্ষেও তাঁদের মার্কামারা নৈরাজ্যের স্রোত বইয়ে দিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের অনুগামীরা। এমনকী বিচারককে পর্যন্ত হুমকি দিলেন তৃণমূলের এক আইনজীবী। মদনের এক অনুগামী আদালত কক্ষেই শাসালেন এক সিবিআই অফিসারকে। আর সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন মন্ত্রী নিজে। দেখা গেল, এজলাসে বসে দিব্যি মোবাইলে কথা বলছেন সারদা কাণ্ডে জেলবন্দি মন্ত্রী!

তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকে আদালতে হাজির করানোর সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল, তৃণমূল সমর্থক একদল আইনজীবী সিবিআইয়ের সওয়ালে বাধা দিচ্ছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গেও বচসায় জড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা। কিন্তু মদনকে আদালতে হাজির করানো শুরু হতেই বিশৃঙ্খলা মাত্রা ছাড়ায়। সেই ইস্তক বিনা বাধায় আদালতের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন ‘মদনদা’র ভক্তরা। তাঁরা হইহল্লা চরমে তুলেছেন, ‘দাদা’র গাড়িতে চড়াও হয়েছেন। ফুলও অবশ্য ছুড়েছেন।

মদন মিত্রের সমর্থনে মিছিল। শুক্রবার কালীঘাটে
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। ছবি: প্রদীপ আদক।

কিন্তু এজলাসে দাঁড়িয়ে সটান বিচারককে হুমকি? স্মরণকালে তার কোনও উদাহরণ পেলেন না আইনজ্ঞরা। শুক্রবারের ঘটনাকে সরাসরি আদালত অবমাননা হিসেবেই দেখছেন বম্বে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় এবং কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, তার জন্য হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তাঁরা।

ব্যাপারটা যে বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে, তা বুঝতে পেরে সওয়াল-জবাবের শেষে মদনের আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের আইনজীবী নেতা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় ক্ষমাও চেয়েছেন বিচারকের কাছে।

‘মদন ইন’ থেকে ‘মদন আউট’ শুক্রবার আলিপুর আদালতে মুূহূর্তে মুহূর্তে যে কত নাটক তৈরি হল, তার ইয়ত্তা নেই!

স্লোগান এজলাসেও

দুপুর আন্দাজ ২টো ২০। আলিপুর আদালতে পৌঁছলেন মদন। পরনে হলুদ পাঞ্জাবি, সাদা চোস্ত পাজামা, নীল স্পোর্টস শু। অন্য অভিযুক্তদের মতো তাঁকে আদালতের লক-আপে আর নিয়ে যাওয়া হল না। গাড়ি থেকে নেমেই সরাসরি ঢুকে গেলেন আদালত কক্ষে। চারপাশে প্রবল হইহই। হাত তুলে কিছু একটা স্লোগান দিচ্ছিলেন মদন। স্পষ্ট শোনা গেল না। আদালতের ভিতরেও তখন মন্ত্রীর অনুগামীর ভিড়। ‘দাদা’ ঢুকতেই তাঁদের গগনভেদী ‘জিন্দাবাদ’ আর ‘বন্দেমাতরম’ চিৎকার। সেই সময়ে আদালতে অন্য একটি মামলার শুনানি চলছিল। সেই শুনানি থামিয়ে বিচারক চেয়ে

থাকেন এই অত্যুৎসাহীদের দিকে। আদালতে হাজির তৃণমূল ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েন। চিৎকার করে অনুগামীদের থামতে বলেন তাঁরা।

কাঠগড়ার পাশে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসানো হয় মন্ত্রীকে। তিনি বসতেই কাঠগড়ার উপরে উঠে পড়েন দু’জন পুলিশ। এক জন সাদা পোশাকের, অন্য জন খাকি পোশাকের রাজ্য পুলিশের কর্মী। যে মামলাটি সেই সময়ে চলছিল, সেটি রিজেন্ট পার্ক থানার। কাঠগড়ায় ছিলেন ওই মামলার এক অভিযুক্ত। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই পুলিশ মিলে তাঁকে কার্যত ঘাড় ধরে নামিয়ে দিলেন কাঠগড়া থেকে। শুরু হল মদন-পর্ব।

মোবাইল লাও

প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা মদনের সামনের দিকটা ছিল ফাঁকা। সে দিকে ছোট মঞ্চের উপরে বসেছিলেন বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়। মন্ত্রীর বাঁ দিকে কাঠগড়া। ডান দিক ও পিছনে অনুগামীর ভিড়।

সেই ভিড় থেকেই বার দুয়েক মোবাইল ফোন চলে এল মদনের হাতে। দেখা গেল, আইনজীবীরা সওয়াল করার সময়ে একনাগাড়ে মোবাইলে কথা বলে চলেছেন মদন। তবে মাথাটা একটু ঝোঁকানো। বিচারকের চোখ এড়াতে কি? মন্ত্রী মোবাইলে কথা বলছেন দেখে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো খাকি পোশাক বোধ হয় সাহস পেলেন। তিনিও মোবাইল বার করে নাড়াচাড়া শুরু করে দিলেন। এক সময়ে দেখা যায়, সাদা কাগজে খসখস করে কিছু লিখছেন মন্ত্রী।

হুঁশিয়ার হুজুর

শুনানি শুরু হওয়ার পর থেকেই তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের একাংশ বিচারককে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন যে, সিবিআইয়ের কৌঁসুলিদের মোটেই বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সংবাদমাধ্যম উল্টোটাই লিখছে। অতএব বিচারকের ‘অর্ডার শিট’-এ এই বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে। ওই আইনজীবীদের বক্তব্য, সিবিআই নিজেও স্বীকার করে নিয়েছে যে, তাদের আইনজীবীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তার পরেও কেন ‘অর্ডার শিট’-এ তা উল্লেখ করা হচ্ছে না? তৃণমূল নেতা-আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আইনজীবীরা যখন কার্যত বিচারকের কৈফিয়ত তলব করছেন, তখন তাঁদের মধ্যে থেকে এক জন শেষ সীমারেখাটাও পেরিয়ে গেলেন। সরাসরি বিচারককে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “আপনি আলিপুর আদালতে বসে এ ভাবে নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পারবেন না।” সেই সুরে আর এক জন বললেন, “আপনি এ ভাবে সিনিয়র আইনজীবীদের আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেন না।”

বিচারক বলেন, “আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন, আদালতের ভিতরে ২০০-৩০০ লোক থাকছেন। এ সবের মাঝে সব কিছু মনে রাখা মুশকিল। তা-ও তো চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

এ বার সিবিআই

মন্ত্রীর পেছন দিকে অনুগামীদের ভিড়। ষণ্ডা চেহারার সব লোক। সেখান থেকেই হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার, “কীসের ভয় দেখাচ্ছেন? মামলা ওড়িশায় নিয়ে যাবেন? নিয়ে যান না! ভয় দেখাচ্ছেন কেন?” শুনানি থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বিচারকও খুঁজছিলেন চিৎকারে উৎস। দেখা গেল, ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছেন এক সিবিআই অফিসার। বোঝা গেল, তাঁকে উদ্দেশ করেই মন্ত্রীর অনুগামীর ওই হুঁশিয়ারি। সিবিআই অফিসারটি অবশ্য লোকটিকে ধর্তব্যের মধ্যেও আনলেন না। তবে চেয়ার ছেড়ে মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন। হাত তুলে থামতে ইশারা করলেন উত্তেজিত ভক্তটিকে।

সিনিয়র সিটিজেন

সওয়াল-জবাব পর্যায়ে এ দিন প্রশ্ন ওঠে, ব্যবসায়ী সজ্জন অগ্রবালকে কেন গ্রেফতার করেনি সিবিআই। সিবিআইয়ের আইনজীবী অঙ্কুশ সরকার বলেন, “উনি বয়স্ক, সিনিয়র সিটিজেন। উনি তদন্তে সহযোগিতা করছেন। তাই ওঁকে গ্রেফতার করা হয়নি।” বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মদন মিত্রও সিনিয়র সিটিজেন। ওঁরও ৬১ বছর বয়স।” বিচারকের অনুমতি নিয়ে এ বার মন্ত্রী নিজেই মুখ খোলেন। বলেন, “সিবিআইয়ের আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী, জেলের বাইরে থেকেও সিবিআইকে সহযোগিতা করা যায়। আমি তো প্রথম থেকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছি। যে দিন ডেকেছে, সে দিন গিয়েছি। আমাকেও তাহলে জামিন দেওয়া হোক। আমি সবরকম সহযোগিতা করব।”

শেষ পর্যন্ত জামিন অবশ্য মেলেনি। তবে এক সময়ে মন্ত্রীকে বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, “জেলে আপনার ঠিক মতো চিকিৎসা হচ্ছে তো? আপনি নিয়মিত ওষুধপত্র পাচ্ছেন?” মন্ত্রী জানান, চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

জুনিয়র সিটিজেন

মদনের হয়ে মূলত সওয়াল করছেন বর্ষীয়ান আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায়। কার্যত তাঁকে শিখণ্ডী খাড়া করেই এ দিন অন্য আইনজীবীরা বিচারককে হুমকি দেন। অশোকবাবু নিজে সওয়াল করার সময়ে বলেন, “আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এ ভাবে আদালতে অভিযোগ জানানো যায় না। ওরা জুনিয়র, তাই হয়তো একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।” পরে বৈশ্বানরও এসে একই ভাবে ক্ষমা চেয়ে নেন বিচারকের কাছে।

শেষ পাত

সওয়াল পর্ব ফুরোল। মদন গেলেন জেলে। তবে পড়ন্ত বিকেলে আদালত চত্বরে রেখে গেলেন চিন্তার পাহাড়। কে জানে, পরের বার মন্ত্রীকে কোর্টে তোলার সময়ে আবার কী নতুন নাটক হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madan mitra cbi saradha scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE