Advertisement
১৮ মে ২০২৪

সংঘর্ষে উত্তপ্ত কেষ্টর পাড়ুই যেন ক্রমে বিজেপির নন্দীগ্রাম

রাজ্যে ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই শক্তি প্রদর্শন করছে বিজেপি। বিশেষ করে অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুক পাড়ুইকেই ‘পাখির চোখ’ করেছে তারা, যেখানে ধাক্কা দেওয়া মানে তৃণমূলের দর্পে আঘাত করা। সে কাজে তারা অনেকটাই সফল। বীরভূমের পাড়ুইয়ে একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা সম্ভবত তারই প্রমাণ। গত বুধবারই রাহুল সিংহের সভায় যাওয়ার পথে পাড়ুইয়ের ইমাদপুরে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন বিজেপি কর্মীরা। তার প্রতিবাদে শনিবার অনুব্রত সেখানে সভা করতে গেলে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে ফের বোমার লড়াই শুরু হয়ে যায়।

আমাদের বাঁচান। পুলিশের কাছে আর্জি এক মহিলার। শনিবার পাড়ুইয়ের সিরশিট্টা গ্রামে।

আমাদের বাঁচান। পুলিশের কাছে আর্জি এক মহিলার। শনিবার পাড়ুইয়ের সিরশিট্টা গ্রামে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩৩
Share: Save:

রাজ্যে ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই শক্তি প্রদর্শন করছে বিজেপি। বিশেষ করে অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুক পাড়ুইকেই ‘পাখির চোখ’ করেছে তারা, যেখানে ধাক্কা দেওয়া মানে তৃণমূলের দর্পে আঘাত করা। সে কাজে তারা অনেকটাই সফল।

বীরভূমের পাড়ুইয়ে একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা সম্ভবত তারই প্রমাণ। গত বুধবারই রাহুল সিংহের সভায় যাওয়ার পথে পাড়ুইয়ের ইমাদপুরে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন বিজেপি কর্মীরা। তার প্রতিবাদে শনিবার অনুব্রত সেখানে সভা করতে গেলে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে ফের বোমার লড়াই শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে শূন্যে গুলি ছুড়তে হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় যে প্রশ্নটা অনেকের সামনে উঠে এসেছে সেটা হল, এ দিন দলের বীরভূম জেলা সভাপতির সভা যতটা ফাঁকা দেখিয়েছে, সেই ফাঁক তৃণমূল পূরণ করবে কী করে?

আগামী ৩০ নভেম্বর কলকাতায় সমাবেশ করতে আসার কথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের। ইতিমধ্যে এ রাজ্যে তাদের সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১০ লক্ষ থেকে রাতারাতি এক কোটি করা হয়েছে। বিজেপির কাছে পরিষ্কার, এই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের ‘শক্তিশালী’ ও ‘নির্ভরযোগ্য’ বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে তৃণমূল বা অন্য দল ছেড়ে আসা কর্মী-সমর্থকেরা তাদের উপরে ভরসা করতে পারেন। আর তাই বেছে নেওয়া হয়েছে অনুব্রতর খাসতালুককে।

আর তাদের রণকৌশল অনেককেই নন্দীগ্রামের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাঁদের মতে, এক দিন ঠিক যে ভাবে নন্দীগ্রামকে সামনে রেখে রাজ্যে নিজেদের উত্থানের বার্তা দিয়েছিল তৃণমূল, পাড়ুইকে সামনে রেখে বিজেপি-ও সম্ভবত সেই একই বার্তা দিতে চাইছে। সে দিক থেকে পাড়ুই কার্যত ‘বিজেপির নন্দীগ্রাম’ হয়ে উঠছে। ঘটনাচক্রে এ দিনই বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ দাবি করেন, “নন্দীগ্রাম যেমন সিপিএমের শেষ কর্মভূমি ছিল, তৃণমূলের জন্য পাড়ুইও তা-ই হবে।” যদিও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এ রাজ্যে বিজেপি যে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তা সফল হবে না। খবরের শিরোনামে থাকার জন্য বিজেপি এটা পরিকল্পনামাফিক করছে।” রাহুলের পাল্টা জবাব, “ওখানে যা হয়েছে, পুরোটাই গ্রামবাসীরা আত্মরক্ষার স্বার্থে করেছেন। এর আগে চৌমণ্ডলপুর আর মাখড়ায় তৃণমূল এবং পুলিশ যা ঘটনা ঘটিয়েছিল, তার জেরে জনরোষও ওখানে তৈরি হচ্ছে।”

পাড়ুইয়ে এ দিন ঠিক কী হয়েছে?

স্থানীয় সূত্রের খবর, বুধবারের সংঘর্ষ নিয়ে ইমাদপুর ও তার আশপাশের এলাকায় চাপা উত্তেজনা ছিলই। এ দিন ইমাদপুর থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে, বনশঙ্কা পঞ্চায়েতের সিরশিট্টা গ্রামে দু’পক্ষে গণ্ডগোল বাধে। খবর পেয়ে দুপুর ২টো নাগাদ ডিএসপি (সদর) পার্থ ঘোষের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী গ্রামে ঢোকে। তৃণমূল কর্মীরা পুলিশকে দেখে নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বিজেপি কর্মীদের বাড়ি থেকে বোমা-অস্ত্র উদ্ধার করার দাবিও তোলেন। কিন্তু গ্রামের পশ্চিমপাড়া ও বাগদিপাড়ার সংযোগস্থলে একটি সেতুর কাছে পুলিশ পৌঁছতেই দু’দিক থেকে বোমাবাজি শুরু হয়ে যায়। পুলিশ চিৎকার করে দু’পক্ষকে থামতে বললেও কেউ তাতে কান দেয়নি। পুলিশের সামনেই প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বোমাবাজি চলে। পুলিশ শেষমেশ শূন্যে পাঁচ রাউন্ড গুলি ছুড়লে দুষ্কৃতীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

কিন্তু গোটা গণ্ডগোলের সময় পুলিশকে কার্যত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামের অনেকেই। বোমাবাজি থামার পরে গ্রামে এসে ক্ষোভের আঁচ পান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় এবং এসডিপিও (বোলপুর) সূর্যপ্রতাপ যাদব। গ্রামের মহিলা সন্ধ্যা বাগদি, সাতু বাগদিরা এগিয়ে এসে বলেন, “আপনারা কী করছেন? আপনাদের সামনেই এ সব হচ্ছে! দয়া করে দুষ্কৃতীদের ধরে গ্রামে শান্তি ফেরান।” গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় জটলা দেখে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “আপনারা এখানে জড়ো হবেন না। যাঁরা জনসভায় যেতে চান, চলে যান।” এলাকায় পুলিশ, র্যাফ ও কমব্যাট বাহিনী মোতায়েন থাকলেও ঘটনায় রাত পর্যন্ত পুলিশ কাউকে ধরেনি। কোনও অভিযোগও দায়ের হয়নি।

কারা প্রথম হামলা চালাল? তৃণমূলের সিউড়ি ২ ব্লক সভাপতি নুরুল ইসলামের অভিযোগ, “তৃণমূলের কাউকে ইমাদপুরের সভায় যোগ দিতে দেওয়া হবে না বলে বিজেপি আগেই হুমকি দিয়ে রেখেছিল। তা নিয়ে সকাল থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়। দুপুরে আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা সভার দিকে পা বাড়াতেই বিজেপির দুষ্কৃতীরা বোমা-গুলি নিয়ে হামলা চালায়।” বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের পাল্টা দাবি, “বিজেপি কর্মীদের তৃণমূলের সভায় যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। তাতে রাজি না হওয়ায় মারধর করা হয়। নিজেদের বাঁচাতেই গ্রামবাসীদের একাংশ প্রতিরোধ করেন বলে শুনেছি।”


পাড়ুইয়ের ইমাদপুরে তৃণমূলের প্রতিবাদসভায় অনুব্রত মণ্ডল ও মনিরুল ইসলাম।

বাম আমলের শেষলগ্নে নন্দীগ্রামে তৃণমূল ঠিক একই ভাবে ‘প্রতিরোধে’ গিয়েছিল। যদিও তার প্রত্যক্ষ কারণ এবং প্রেক্ষিত ছিল আলাদা। ২০০৬-এর ডিসেম্বরে হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। ৭ ডিসেম্বর ভূতার মোড়ে পুলিশের জিপ পুড়িয়ে প্রথম সংঘর্ষ শুরু করেন গ্রামবাসীরা। পরে আন্দোলনের রাশ হাতে নেন দক্ষিণ কাঁথির তৎকালীন বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। পাড়ুইয়ের সঙ্গে জমি আন্দোলনের কোনও যোগ নেই। কিন্তু এক দিকে শাসকদলের রাজনৈতিক জমি হারানো, অন্য দিকে সংখ্যালঘুদের ক্রমশ বিরোধী শিবিরে সরে যাওয়া দু’দিক থেকেই পাড়ুই এবং নন্দীগ্রামের মিল রয়েছে।

কিন্তু অনুব্রত মণ্ডলের মতো দাপুটে নেতা থাকতেও (যিনি প্রকাশ্যে পুলিশকে বোমা মারতে বলেও পার পেয়ে যান) সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পাড়ুইয়ে তৃণমূল জমি হারাচ্ছে কেন? অনেকের মতে, পঞ্চায়েতের দখলদারি নিয়ে ওই এলাকায় ‘আদি তৃণমূল’ বনাম ‘নব্য তৃণমূল’ লড়াই শুরু হয়েছিল। কসবা গ্রামের সাগর ঘোষের পরিবার ‘আদি তৃণমূল’ বলে এলাকায় পরিচিত ছিল। কিন্তু অনুব্রতরা সদ্য দলে আসা লোকজনকে পঞ্চায়েতে টিকিট দেওয়ায় পুরনো কর্মীরা ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। সেই বিবাদের জেরেই সাগর ঘোষ খুন হন। তাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ তৃণমূল কর্মী হয়েও নির্দল হিসেবে প্রার্থী হয়েছিলেন পঞ্চায়েতে। শেষ পর্যন্ত তিনি হারলেও বিক্ষুব্ধরা কসবা পঞ্চায়েত ছিনিয়ে নেয়। তাঁদের আমন্ত্রণেই বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের সেখানে আসা এবং সংগঠন বিস্তার। কেন্দ্রের শাসক দলের কাছে আশ্রয় পেতে সুবিধা হবে ভেবে কংগ্রেস ও বাম কর্মী-সমর্থকদের একাংশও বিজেপির ছাতার তলায় আসতে শুরু করেছেন। বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন হৃদয়বাবুও।

এখন শুধু পাড়ুই নয়। বরং তাকে কেন্দ্র করে বিজেপির সংগঠন চারপাশে ছড়াচ্ছে। আশপাশের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নানুর, কীর্ণাহার, লাভপুর প্রভৃতি এলাকার মানুষও বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন। প্রভাব পড়েছে বর্ধমানেও। বিশেষ করে অনুব্রত যে সব এলাকা দেখেন, সেই আউশগ্রাম, কেতুগ্রাম আর মঙ্গলকোটের পশ্চিম অংশে একই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দুধকুমারের কথায়, “যেন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বান ডেকেছে! তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে মানুষের এতটা ক্ষোভ জমেছে, তা আমরাও বুঝতে পারিনি। এখন রোজই ওই অঞ্চল থেকে দলে-দলে লোক পার্টি অফিসে এসে পতাকা নিয়ে যাচ্ছে। নিজেরাই পার্টি অফিস খুলছে। নন্দীগ্রামেও তো বামেদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে মানুষ রাতারাতি তৃণমূল হয়ে গিয়েছিল।”

নন্দীগ্রামের সঙ্গে আরও মিল রয়েছে পাড়ুইয়ের। সেখানে আন্দোলন দমাতে সিপিএম খেজুরি-পটাশপুর-কেশপুর থেকে মাস্কেট বাহিনী আনলেও গ্রামবাসীদের আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদের পিছিয়ে যেতে হয়। পাড়ুইয়ের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, সেখানে বিজেপির ছড়িয়ে পড়া রুখতে অনুব্রত-বাহিনী গ্রাম দখলের পরিকল্পনা করেছে। মূলত মুর্শিদাবাদ এবং ঝাড়খণ্ডের দুষ্কৃতীরা এই কাজে নেমেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা কোনও গ্রামেরই দখল নিতে পারেনি। উল্টে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিজেপির পতাকা। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে দেড় বছরে প্রায় এক হাজার রাজনৈতিক মামলা হয়েছিল। মামলার জালে জড়িয়েছিলেন মূলত আন্দোলনকারীরাই। পাড়ুইয়েও একই কায়দায় বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ পরপর মামলা করছে, এমনকী একই সংঘর্ষের ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে লঘু এবং বিজেপির বিরুদ্ধে গুরুতর মামলা দিচ্ছে বলে অভিযোগ। রাহুলবাবুর বক্তব্য, “বীরভূমে একের পর এক গ্রামে এখন বিজেপির ঝান্ডা উড়ছে। এতেই আতঙ্কিত হয়ে পুরনো কায়দায় তৃণমূল এবং পুলিশের যৌথ বাহিনী গ্রাম দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।”

পাড়ুই যে তৃণমূলের ‘রাজনৈতিক বধ্যভূমি’ হয়ে উঠতে পারে, তার ইঙ্গিত এ দিন তৃণমূলের সভার বহরেই রয়েছে বলে অনেকের মত। রাহুলের দশ হাজার লোকের সভার পাল্টা হিসেবে অনুব্রতরা যে সভা করলেন, সেখানে লোক ছিল মেরে-কেটে হাজার তিনেক। যদিও অনুব্রত সভায় হুঙ্কার দেন, “২০১৬ সালের ভোটে তৃণমূল বীরভূমের ১১টা আসনেই জিতবে। একটি আসনও যদি হারাই, আমি সভাপতির পদ ছেড়ে দেব!” দলেরই অনেকের মতে অনুব্রত যে কতটা চাপে আছেন, এই হুঙ্কার থেকেই তা স্পষ্ট।

ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parui nandigram bjp tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE