Advertisement
E-Paper

সাম্রাজ্য গড়া বারিকের নামে আগে অভিযোগ নেই কেন, ধন্দ

পেট চলত গাড়ি ধুয়ে। খালাসি হিসেবে খেটে। এখন রাজ্য জুড়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করে বসে আছে বসিরহাটের আব্দুল বারিক বিশ্বাস। সোনা পাচারের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করার পরে, এমনই দাবি করেছে ডিআরআই (ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স)।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৪ ০৩:৪৯
আব্দুল বারিক বিশ্বাস

আব্দুল বারিক বিশ্বাস

পেট চলত গাড়ি ধুয়ে। খালাসি হিসেবে খেটে। এখন রাজ্য জুড়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করে বসে আছে বসিরহাটের আব্দুল বারিক বিশ্বাস।

সোনা পাচারের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করার পরে, এমনই দাবি করেছে ডিআরআই (ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স)। তাদের দাবি, রাজ্যে গরু পাচারে জড়িতদের তালিকাতেও উপরের দিকেই নাম রয়েছে বারিকের। গত দু’দশকের মধ্যে সামান্য গাড়ি সাফাইয়ের কর্মী থেকে তার এই ‘উত্থান’ রূপকথার মতোই ঠেকেছে অনেক গোয়েন্দার কাছেও। অথচ, ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত বছর বিয়াল্লিশের এই যুবকের বিরুদ্ধে এ রাজ্যে কোথাও কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি।

সালটা ১৯৯২। বাদুড়িয়া থানার সীমান্তবর্তী কাটিয়াহাট গ্রাম থেকে যে তরুণ নিত্য গাড়ি সাফাই করতে আসত বসিরহাট সদরে, সে-ই যে এক দিন চোরাপাচারে জড়িয়ে এলাকার ‘দাদা’ (এই নামেই পরিচিত বারিক) হয়ে উঠবে, ভেবে এখনও অবাক হন স্থানীয় বাসিন্দারা। বছর ষোলোর সে-ই তরুণ তখন ৫০ টাকা রোজে পেট চালাত। খালাসি হিসেবে কাজ করতে করতে এক দিন সে হয়ে গেল ছোটগাড়ির চালক। সেই ছোটগাড়িতে করেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সে মোটা টাকার বিনিময়ে পৌঁছে দিত কলকাতা শহরের আনাচেকানাচে। পড়াশোনা তেমন না জানলেও তীক্ষ্ন বুদ্ধির জোরে অল্প দিনেই মধ্যেই পাচারকারী দলের নিয়ন্ত্রক হয়ে যায় বারিক। অনুপ্রবেশকারীদের কাছ থেকে ভাড়াও মিলত বাজারচলতি দরের চেয়ে অনেক বেশি। বছর বছর সেই টাকা জমিয়ে সে লরি কেনে। ২০০৯ থেকে চালু করে লরি করে গরু পাচার। বারিক বিশ্বাসের ফুলেফেঁপে ওঠার সেই শুরু।

অল্প দিনের মধ্যেই বসিরহাটের সংগ্রামপুরে বিশাল বাড়ি হল। নেতা-মন্ত্রী থেকে পুলিশ-প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে তার দহরম-মহরমও দেখেছেন এলাকাবাসী। দুঃস্থ মানুষ, ক্লাব বা ধর্মীয় সংগঠনআর্থিক সাহায্যের হাত বাড়াতে পিছ-পা হত না বারিক। প্রভাব এবং প্রতিপত্তি দেখে চোখ টাটালেও, থানামুখো হওয়ার সাহস ছিল না এলাকাবাসীর। তবে তাঁদের বক্তব্য, “গরুপাচারের সাম্রাজ্য কার, সে খবর কি পুলিশের কাছে ছিল না? তা হলে পুলিশ নিজে থেকে মামলা করেনি কেন?”

স্থানীয় সূত্রের খবর, পুলিশের তরফে বাধা না পেয়ে গরু পাচার করে পাওয়া টাকা সোনা পাচারে লাগাতে শুরু করে বারিক। ভারতবর্ষে সোনার উপরে আমদানি শুল্ক বেড়ে ১০ শতাংশ হওয়ার পরে তার পোয়া বারো হয়। এই মওকা কাজে লাগাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গরু পাচার করে দাম বাবদ সোনার বাট বা বিস্কুট আনা বেড়ে যায়। এক কিলোগ্রাম সোনা চোরাপথে কলকাতায় পৌঁছে দিতে পারলেই হাতে-হাতে ৩ লক্ষ টাকা পায় পাচারকারী। বারিকের সাম্রাজ্যে এমন হাজার খানেক ছোট-বড় পাচারকারী রয়েছে বলে দাবি গোয়েন্দাদের।

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানোতেও মন গিয়েছে বারিকের। স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে বসিরহাট ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতিতে জেলা পরিষদের তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে তার নাম স্থানীয় ভাবে উঠেও এসেছিল। কিন্তু বারিক সেখানে প্রার্থী করে দাদা গোলাম বিশ্বাসকে। সেই সময় প্রচার অনুষ্ঠানে একাধিক নায়ক-নায়িকাকে দেখেছে বসিরহাট। ওই সময় গরু পাচারের টাকায় ভোট কেনা হচ্ছে বলে সিপিএম এবং কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছিল। তৃণমূল অভিযোগ মানেনি।

এখনও বারিকের সঙ্গে দলের কোনও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে মানছেন না তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর বক্তব্য, “গোলাম বিশ্বাস আমাদের দলের লোক। তাঁর ভাই কী করেন, কী করে জানব?” গত পঞ্চায়েত ভোটেই তৃণমূলের পতাকা গলায় ঝুলিয়ে মঞ্চে-মঞ্চে বক্তব্যও রাখতে দেখা গিয়েছিল বারিককে। দলের অনুমতি ছাড়া তেমন কি করা সম্ভব? জ্যোতিপ্রিয়র দাবি, “ওটা কংগ্রেসের কারসাজি। কংগ্রেস আমাদের দলের পতাকা দিয়ে বারিককে মঞ্চে পাঠিয়েছিল। পুলিশকে বলা হয়েছে, দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি এবং তৃণমূলের প্রতীক নিয়ে যদি অন্য দলের কেউ অপব্যবহার করে, তা হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।” যদিও কংগ্রেসের জেলা নেতা অসিত মজুমদার মন্ত্রীর অভিযোগ মানেননি। তাঁর পাল্টা দাবি, “গরু বা সোনা পাচারে বারিকের জড়িত থাকার কথা কারও অজানা নয়। দাদাকে জেতাতে তৃণমূলের মঞ্চে প্রচারও করেছে ও।”

বারিকের দাদা গোলাম বিশ্বাস অবশ্য বলেছেন, তৃণমূলকে বদনাম করতেই তাঁর ভাইকে ফাঁসানো হয়েছে। জেলা তৃণমূলের একাধিক নেতার বক্তব্য, “যে সময় বারিকের উত্থান, সে সময় তো আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক সবাই জানে।”

“কোনও কালেই বারিক বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও যোগাযোগ ছিল না”, দাবি সিপিএমের জেলা নেতা অমিতাভ নন্দীর। তাঁর সংযোজন, “বারিক আমাদের আমলে বিরোধীদের সঙ্গে ছিল। এখনও রয়েছে শাসক দলের সঙ্গে।” সিপিএম নেতাদের একাংশ আবার অভিযোগ করেছেন, বারিকের কাছ থেকে যে দু’টি রিভলবার পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির লাইসেন্সের জন্য সুপারিশ করেছেন বসিরহাটের বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ নুরুল ইসলাম। তবে নুরুল ইসলাম বলেন, “ভোটের আগে ফায়দা তুলতে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। কাউকেই রিভলভারের লাইসেন্সের জন্য সুপারিশ করিনি। আর আমি সুপারিশ করলেও পুলিশ বা প্রশাসনের তদন্ত ছাড়া তো কারও লাইসেন্স পাওয়ারও কথা নয়! ”

জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, “একটি লাইসেন্স এর ভিত্তিতে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র রাখা যায়। লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে কেউ সুপারিশ করলেও আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার আগে পুলিশ ও প্রশাসন তদন্ত করে। এ ক্ষেত্রেও তদন্ত হয়েছে।” তদন্তে তা হলে এই সোনা বা গরু পাচারকারী সম্পর্কে কিছু পাওয়া গেল না কেন? জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাষ্কর মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বারিকের বিরুদ্ধে কোনও থানায় অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলেই আগে কিছু করা যায়নি। ধরাও যায়নি ওকে।”

abdul barik biswas arunakksha bhattacharya nirmal basu trafficking
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy