Advertisement
E-Paper

সারদা-চক্রী নেতাদের নাম বন্ধ খামে

সারদা-র আর্থিক কেলেঙ্কারিতে রাজনৈতিক যোগসাজশের অভিযোগের দিকে এ বার নজর দিল সুপ্রিম কোর্ট। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আজ শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছে, সারদা-কাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েক জন প্রাক্তন মন্ত্রী-সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা সম্পর্কেও তদন্ত হয়েছে, যাঁদের নাম আদালতে পেশ করা হয়েছে মুখবন্ধ খামে। পাশাপাশি রাজ্য সরকার এ দিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি টিএস ঠাকুর ও বিচারপতি সিএস নাগাপ্পনের বেঞ্চে হলফনামা দিয়ে দাবি করেছে, সারদা-কেলেঙ্কারির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ধৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষেরও, যিনি কি না সারদা গোষ্ঠীর মালিক সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সাদাসিধে লগ্নিকারীদের সারদায় টাকা রাখতে উৎসাহিত করতেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩১

সারদা-র আর্থিক কেলেঙ্কারিতে রাজনৈতিক যোগসাজশের অভিযোগের দিকে এ বার নজর দিল সুপ্রিম কোর্ট।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার আজ শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছে, সারদা-কাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েক জন প্রাক্তন মন্ত্রী-সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা সম্পর্কেও তদন্ত হয়েছে, যাঁদের নাম আদালতে পেশ করা হয়েছে মুখবন্ধ খামে। পাশাপাশি রাজ্য সরকার এ দিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি টিএস ঠাকুর ও বিচারপতি সিএস নাগাপ্পনের বেঞ্চে হলফনামা দিয়ে দাবি করেছে, সারদা-কেলেঙ্কারির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ধৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষেরও, যিনি কি না সারদা গোষ্ঠীর মালিক সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সাদাসিধে লগ্নিকারীদের সারদায় টাকা রাখতে উৎসাহিত করতেন। কুণালবাবুর পক্ষে এ দিন সুপ্রিম কোর্টকে জানানো হয়, তিনি আদালতে নিজের বক্তব্য পেশ করতে চান। তাঁর কৌঁসুলিকে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন জমা দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। মামলার পরবর্তী শুনানি ১৬ এপ্রিল।

সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্তের আর্জি সংক্রান্ত মামলাটিতে এর আগে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যের কাছে জানতে চেয়েছিল, কেলেঙ্কারির নেপথ্যে থাকা ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ প্রকাশ্যে আনতে কী তদন্ত হয়েছে? ঘটনায় রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জড়িত ছিলেন শুনে এ দিন বিচারপতিদের প্রশ্ন, ওঁরা কী ভাবে সারদার থেকে লাভবান হতেন? রাজ্যের জবাব, এঁরা কেউ সারদার কাছ থেকে মাসে-মাসে টাকা পেতেন, কেউ আবার এককালীন টাকা নিয়েছেন। রাজ্যের এ হেন ব্যাখ্যা শুনে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ, সারদা-কেলেঙ্কারিতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ভূমিকা, কী ভাবে তাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তে কী কী তথ্য মিলেছে, এ সব সংক্ষেপে জানানো হোক।

উল্লিখিত নেতারা কী ভাবে সারদার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা কবে, কত টাকা নিয়েছেন, সেই সম্পর্কিত গোপন তথ্যও এ দিন মুখবন্ধ খামে আদালতে পেশ করা হয়। ওই সব নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কি না, কোর্ট তা জানতে চাইলে রাজ্যের কৌঁসুলি সিএস বৈদ্যনাথন বলেন, “অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও অনেককে নোটিস পাঠানো হয়েছে। কেউ সারদার থেকে প্রতি মাসে টাকা নিয়েছেন, কেউ নিয়েছেন এককালীন।” শুনে বিচারপতি ঠাকুরের মন্তব্য, “এ থেকে যে বড় ছবিটা উঠে আসছে, তা হল, গোটা ব্যবস্থাটাই এঁদের চাপে ভেঙে পড়েছিল!” সিবিআই-তদন্তপ্রার্থী আবেনকারীদের কৌঁসুলি শুভাশিস ভৌমিক পরে এ প্রসঙ্গে কোর্টের বাইরে বলেন, “চার জন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নাম উঠে এসেছে। তাঁদের বিষয়েই তথ্য চাইছিল আদালত।”

আজকের সওয়ালে রাজ্যের আইনজীবী বৈদ্যনাথন জানান, সারদার সফ্টওয়্যার অনুযায়ী ২৪৬০ কোটি টাকা বাজার থেকে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেটাই সঠিক অঙ্ক কি না, সন্দেহ রয়েছে। কারণ, সারদার বহু এজেন্ট আমানতকারীদের থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাতেন, যাতে এজেন্ট-কমিশন বাবদ বেশি টাকা পাওয়া যায়। আর এ জন্য সংস্থার পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে এজেন্টরা আঁতাত করেছিলেন বলে অভিযোগ তুলে রাজ্যের কৌঁসুলির দাবি, সুদীপ্ত সেন সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে এটাকেই সংস্থার লাটে ওঠার প্রধান কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শুনে বিচারপতি ঠাকুরের মন্তব্য, “এটা সত্যি হলে তো বলতে হয়, কার্যত লুঠ চলছিল!” এজেন্টদের জেরা করা হয়েছে কি না, বিচারপতির এই প্রশ্নের উত্তরে রাজ্য জানায়, বেশির ভাগকেই জেরা করা হয়েছে।

একই সঙ্গে রাজ্য সরকারের হলফনামায় আজ সুদীপ্ত সেন-সহ সারদা-কর্তাদের পাশাপাশি ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ বড় দায় চাপানো হয়েছে কুণাল ঘোষের ঘাড়ে। ধৃত তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে রাজ্যের অভিযোগ: সারদার মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও হিসেবে কুণালবাবু মাসে ১৫ লক্ষ টাকা বেতন নিতেন, অথচ সংস্থার বেতনভুক্ত কর্মীদের তালিকায় তাঁর নাম মেলেনি! রাজ্যের অভিযোগ: কুণালের চাহিদামতো সুদীপ্ত তাঁকে টাকা জোগাতেন। শুধু তা-ই নয়, সুদীপ্ত কী ভাবে টাকা সংগ্রহ করছেন, কী ভাবে তা লোকসানে চলা সংস্থায় খাটাচ্ছেন এর সবই কুণালের জানা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হলফনামায় এ-ও বলা হয়েছে, সাংসদ-সাংবাদিক হিসেবে কুণাল যথেষ্ট ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন এবং নিজের পদ ও ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি সরল-সাধাসিধে লগ্নিকারী ও এজেন্টদের সারদায় টাকা ঢালতে উৎসাহিত করেছেন। এ ব্যাপারে রাজ্যের পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের দুই মন্ত্রীর দুই আপ্ত সহায়ক গণেশ দে ও অঞ্জন ভট্টাচার্যের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার। তাঁরা ছিলেন যথাক্রমে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত ও প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবের আপ্ত সহায়ক।

এ দিকে রাজ্য সরকার যখন সুপ্রিম কোর্টের সামনে তাঁকে সারদা-কাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, তখন আজই প্রথম শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলেন কুণাল ঘোষ। এ দিন আদালতে তাঁর কৌঁসুলি শাম্ব নন্দী অভিযোগ করেন, কুণালবাবুকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গোপন জবানবন্দি দিতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকী, পুলিশি জেরার মুখে তাঁর দেওয়া বয়ানও চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। আদালতের কাছে শাম্ববাবুর আর্জি, তাঁর মক্কেলও সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত চান, তাই এই

মামলায় কুণাল ঘোষের বক্তব্য শোনা হোক। তাঁর কথা শুনে রাজ্যের আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া, “যেখানে অন্যতম অভিযুক্তই সিবিআই-তদন্ত চাইছেন, সেখানে বুঝতে অসুবিধে নেই যে, আবেদনের পিছনে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে!”

শীর্ষ আদালত অবশ্য কুণালবাবুর বক্তব্য পেশের ব্যাপারে তাঁর কৌঁসুলিকে লিখিত ভাবে আবেদন পেশ করতে বলেছে। পাশাপাশি কোর্ট আজ জানতে চায়, এই ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করতে তদন্ত হচ্ছে কোন মামলার আওতায়? রাজ্য জানায়, কলকাতার কেষ্টপুরের বাসিন্দা মল্লিকা চট্টোপাধ্যায় সারদায় টাকা খাটিয়ে প্রতারিত হয়ে বিধাননগর (উত্তর) থানায় যে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তারই চার্জশিটে গোটা ষড়যন্ত্রের বিশদ তথ্য থাকবে। উপরন্তু ফরেন্সিক অডিটের মাধ্যমে সারদার লোপাট টাকার হদিস পেতে একটি সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছে। সব রিপোর্ট হাতে এলে আগামী ৮-১০ সপ্তাহের মধ্যে চার্জশিট পেশ করা হবে বলে এ দিন সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে রাজ্য।

এর পরেও সর্বোচ্চ আদালত আজ ফের প্রশ্ন তোলে, সারদা-মামলার তদন্তভার সিবিআই-কে দিতে রাজ্যের আপত্তি কেন?

জবাবে বৈদ্যনাথনের ব্যাখ্যা: দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁরা সিবিআইয়ের উপরে ভরসা রাখতে পারছেন না। তাঁর দাবি: রাজ্য প্রশাসন স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত করছে। এ অবস্থায় সিবিআই এলে তদন্ত পথভ্রষ্ট হবে, দেরিও হবে অনর্থক। তদন্তকারী পুলিশবাহিনীও হতাশ হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টই রাজ্যের তদন্তে নজরদারি চালাতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিচারপতিরা অবশ্য জানিয়ে দেন, তাত্ত্বিক বিষয়ে আদালতের কোনও উৎসাহ নেই। “রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এখানে জড়িত। আদালতের নজরদারিও সব ক্ষেত্রে কার্যকরী হয় না।” মন্তব্য বেঞ্চের।

সুপ্রিম কোর্টে সারদা-মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে আগামী ১৬ এপ্রিল, যার পর দিনই পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্বের সূচনা। রাজ্যের তরফে অন্য কৌঁসুলি মুকুল রোহতাগি আজ সওয়ালে দাবি করেন, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত চাওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। তাই ভোট পর্ব মিটে যাওয়ার পরে মামলার শুনানি হোক। সারদা-কাণ্ডে ‘রাজনৈতিক যোগ’ সংক্রান্ত তথ্য পেশের জন্যও দশ দিন সময় চেয়েছিল রাজ্য। “নির্বাচন কমিশন বহু পুলিশ অফিসারকে বদলি করে দিয়েছে। তাই বেশি সময় দরকার।” যুক্তি দিয়েছিলেন রোহতাগি। অন্য দিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, রাজ্য আসলে সিবিআই-তদন্তে ভয় পাচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টও রাজ্যের আর্জিতে কান দেয়নি। “এটা কোনও সাধারণ ব্যাপার নয়। বিষয়টা অ-সাধারণ (এক্সট্রা-অর্ডিনারি)। কাজেই এত সময় দেওয়া যাবে না।” জানিয়ে দেন বিচারপতি ঠাকুর।

sarada supreme court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy