উন্নয়নের অর্থের জন্য প্রতি পদে হা পিত্যেশ করে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। অথচ উন্নয়নেরই স্বার্থে কেন্দ্রের দেওয়া ১৮২ কোটি টাকা কাজে না-লেগে স্রেফ পড়ে রইল রাজ্যে! যে জন্য আঙুল উঠেছে জেলা প্রশাসনের ‘গাফিলতি’ এবং কিছু সাংসদের ‘গা-ছাড়া’ মনোভাবের দিকে।
পাঁচ বছরের লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সাংসদ এলাকা উন্নয়ন তহবিল (এমপিল্যাড)-এর অনেকটাই ব্যবহার করতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ সাংসদ। শেষ মুহূর্তে কাজে গতি আনতে কয়েক জন হুড়োহুড়ি শুরু করেছেন। ওঁদের অধিকাংশ দায় ঠেলছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের ঘাড়ে। অন্য দিকে প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের দাবি, তহবিলের টাকা এমপি’রা হাতে পান না বলেই খরচের ব্যাপারে ওঁদের চাড় কম। “এমপি’দের পরিকল্পনাগুলোর রূপায়ণ কেমন হচ্ছে, তা দেখার দায়িত্ব তো ওঁদেরই! কিন্তু নানা ব্যস্ততায় তাঁরা এ দিকে সময় দিতে পারছেন না।” আক্ষেপ করছেন নবান্নের এক প্রশাসনিক কর্তা।
বস্তুত ‘ব্যস্ততা’র যুক্তি অনেকেই দিয়েছেন। তবে ঘটনা হল, বিস্তর ব্যস্ততা সত্ত্বেও উন্নয়নের অর্থ ব্যবহারে গাফিলতি করেননি এমন সাংসদও রয়েছেন কয়েক জন। যেমন, দেশের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ। দার্জিলিঙের বিদায়ী বিজেপি সাংসদ এমপিল্যাডের ১৯ কোটি টাকার প্রায় ৯৯% খরচ করে ফেলেছেন গত পাঁচ বছরে। অসুস্থতা সত্ত্বেও বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ গোবিন্দ নস্কর প্রায় সমস্ত অর্থ কাজে লাগিয়েছেন। কেন্দ্রীয় খতিয়ান অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও। তৃণমূলের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে অঞ্চল, সেই নন্দীগ্রামের উন্নয়নে বিশেষ নজর দিয়েছেন শুভেন্দুবাবু।
ওঁরা ছাড়াও সাফল্য-তালিকার উপরের দিকে রয়েছেন মেদিনীপুরের সিপিআই সাংসদ প্রবোধ পন্ডা, কলকাতা উত্তরের তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা দক্ষিণের তৃণমূল সাংসদ সুব্রত বক্সি, ঝাড়গ্রামের সিপিএম সাংসদ পুলিনবিহারী বাস্কে, বারাসতের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার প্রমুখ। প্রবোধবাবু যেমন প্রাপ্ত অর্থের ৯২% খরচ করেছেন। সুব্রতবাবু করেছেন ৮৬%। সুদীপবাবুর খরচের হার ৭৯%, পুলিনবাবুর ৮৭%, কাকলিদেবীর ৯২%। আছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল ও বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়ও। রাজ্যের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের হিসেবে তাপসবাবু প্রায় ৮৫% টাকা খরচ করতে পেরেছেন। শতাব্দী করেছেন প্রায় ৮০%। যদিও তাপসবাবুর দাবি, “আমি পুরোটাই খরচ করেছি। ডিএমের কাছে হিসেব আছে।”
কিছু ক্ষেত্রে কাজ শেষ হয়ে গেলেও কাগজ জমা না-পড়ায় সরকারি খতিয়ানে তার উল্লেখ না-থাকার সম্ভাবনা অবশ্য রয়েছে। এমপিল্যাডের কত টাকা খরচ হয়নি আর কত টাকার ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ জমা পড়েনি, তা খতিয়ে দেখতে ২০১৩-র ২০ নভেম্বর দিল্লিতে বৈঠক হয়েছিল। তার পরে রাজ্যের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের বিশেষ সচিব সমস্ত জেলাশাসক ও কলকাতা পুরসভার কমিশনারকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছেন, এমপিল্যাডের সম্পূর্ণ কাজের শংসাপত্র ১ মার্চের আগে পাঠিয়ে দিতে হবে। এখনও অনেক চিঠি জমা পড়েনি।
এ তো গেল ‘খরুচে’দের কথা। পশ্চিমবঙ্গে সাংসদ তহবিলের টাকা খরচ করতে পারেননি যাঁরা, তাঁদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় (জঙ্গিপুর, কংগ্রেস), তরুণ মণ্ডল (জয়নগর, এসইউসি), দীপা দাসমুন্সি (রায়গঞ্জ, কংগ্রেস), প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় (হাওড়া, তৃণমূল), মনোহর তিরকে (আলিপুরদুয়ার, আরএসপি), শক্তিমোহন মালিক (আরামবাগ, সিপিএম), সুস্মিতা বাউড়ি (বিষ্ণুপুর, সিপিএম), সুলতান আহমেদ (উলুবেড়িয়া, তৃণমূল) প্রমুখ। ওঁরা কেন পারলেন না? এলাকার সব উন্নয়নের কাজ কি শেষ?
প্রায় সাত কোটি টাকা ফেলে রাখা বিষ্ণুপুরের সুস্মিতাদেবীর যুক্তি, “এমপি’দের কাজ করার অধিকার নেই। এমপিল্যাডের টাকা খরচ হয় জেলা প্রশাসনের হাত দিয়ে। তদ্বির ছাড়া কিছু করতে পারি না। জেলা প্রশাসনকে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। ওদেরও গাফিলতি রয়েছে।” পাশাপাশি রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কারণেও টাকা বরাদ্দে সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে সিপিএম সাংসদের দাবি। রায়গঞ্জের দীপাদেবী বলেন, “আমার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ করা হয়েছে। দু’টো সেতু আর একটা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে। কিন্তু সেগুলোর কাজ শুরুই হয়নি। তাই টাকা পড়ে রয়েছে।”
জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে আনা সাংসদদের অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকেরা অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এ দিকে ব্যর্থ তালিকার কিছু সাংসদ প্রকল্প রূপায়ণকারী বিভিন্ন সংস্থাকেও দুষছেন। বলছেন, “ঠিক সময়ে কাজ শেষ হলেও ওরা ইউসি দেয় না। আমরা কী করব?” তৃণমূলের এক সাংসদের কথায়, “টাকাটা আমরা চোখে দেখি না, ছুঁতেও পারি না। শুধু স্কিম জমা দিই।” তবে কাজ ঠিকঠাক এগোচ্ছে কি না, সেই তদারকিতে তাঁর তরফে কিছু ঘাটতি থেকে গিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
তহবিল ব্যবহারে ব্যর্থ সাংসদদের অনেকেরই যুক্তি, অন্য নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় তদারকির দিকটায় বিশেষ নজর দিতে পারেননি। যার পাল্টা যুক্তি হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উঠছে। কী রকম?
প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য: ২০০৯-এ দিল্লির বিদেশ ও অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব এক হাতে সামলাতেন জঙ্গিপুরের কংগ্রেস সাংসদ, অধুনা দেশের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সে সময়ে এমপিল্যাডে বছরে দু’কোটি করে মিলত। পাঁচ বছরে প্রণববাবু দশ কোটির প্রায় সাড়ে ৯ কোটি খরচ করেছিলেন। অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত রায়গঞ্জের তদানীন্তন কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির ব্যস্ততাও কম কিছু ছিল না। তথ্য-সম্প্রচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রকের দায়িত্ব ছিল তাঁর উপরে। তবু ২০০৯-এ এলাকা উন্নয়নের টাকা সদ্ব্যবহারকারীদের তালিকায় তিনি জায়গা করে নেন। আর সেই সময়ে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন রাজ্যের তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী তথা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি কি না ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের আগেই প্রায় ৯ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছিলেন। বাকি টাকার পরিকল্পনা জমা দিতেও তিনি দেরি করেননি।
প্রথম দু’বছর দু’কোটি করে, এবং শেষ তিন বছরে পাঁচ কোটি করে গত পাঁচ বছরে এমপিল্যাডে সাংসদদের প্রত্যেকে পেয়েছেন ১৯ কোটি টাকা। ওঁদের মেয়াদ শেষে রাজ্যের এমপিল্যাডের যে ১৮২ কোটি আদৌ খরচ হল না, তার কী হবে?
নিয়ম মোতাবেক, লোকসভা ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেলে সাংসদেরা এলাকা উন্নয়ন তহবিলে পড়ে থাকা অর্থ আর পাবেন না। পরের বার যাঁরা জিতে আসবেন, অব্যবহৃত টাকা ব্যয় করার অধিকার তাঁদেরই।