পূর্বস্থলীর তৃণমূল নেতা সজল ঘোষ খুনের মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন সিপিএমের প্রদীপ সাহা-সহ পাঁচ জন। কিন্তু খুনের কিনারা হয়নি। বরং তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই সজল খুন হয়েছিলেন কি না, সেই সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
সেই কিনারা করতে এ বার সিবিআই তদন্ত চাইছেন সদ্য মুক্তি পাওয়া কুলকামিনী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপবাবুই। শুক্রবার তিনি বলেন, “তৃণমূল যে সংস্কৃতির দল তার থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন সজল ঘোষ। এলাকায় ভাল ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর খুনির শাস্তি চাই। আমি আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করছি। প্রকৃত হত্যাকারী কে, তা জানার জন্য আদালতের কাছে সিবিআই তদন্তের আবেদন জানাব।”
সিপিএমের একটি অংশের দাবি, নবদ্বীপ হাসপাতাল চত্বরে সজলবাবুকে গুলি করে মারা হয়েছিল বলে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, তা সত্য নয়। সেই কারণেই যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলেনি। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অঞ্জু কর বলেন, “আমাদের সন্দেহ, সজল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের স্বীকার। ওঁকে বাইরে কোথাও খুন করে হাসপাতালে দেহ ফেলা হয়েছে। সেই মিথ্যার ফানুস ফেটে গিয়েছে। লোকে জানতে চাইছে, সজল ঘোষের প্রকৃত খুনি কে? তৃণমূলের কাছে এর উত্তর চাই।”
কিন্তু খুনির হদিস মিলবে কী করে? নবদ্বীপ থানার আইসি তপনকুমার মিশ্র জানান, আদালতের রায় হয়ে যাওয়ার পরে এখন ফের নতুন করে তদন্তের সম্ভাবনা নেই। তবে কোনও পক্ষ উচ্চতর আদালতের দ্বারস্থ হলে, তারা যা নির্দেশ দেবে সেই মতো কাজ হবে। এখনও পর্যন্ত তৃণমূলও নতুন করে তদন্ত চায়নি। সজলবাবুর স্ত্রী, সদ্য প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পাওয়া ইন্দ্রাণী ঘোষ গত দিনই কোনও কথা বলতে চাননি। এ দিন তাঁর মোবাইল বন্ধ ছিল। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে নবদ্বীপ হাসপাতালে আমাদের দলের পূর্বস্থলী অঞ্চলের সহ-সভাপতি সজল ঘোষ খুন হয়েছিলেন। এর মধ্যে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। তবে আদালতের রায় নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। মানুষের আদালত এর বিচার করবে।”
অঞ্জুদেবীরা বলছেন, নিজেদের প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করে তৃণমূলের পাঁচ জন যে বয়ান দিয়েছে, তা অসঙ্গতিতে ভরা। যেমন, অভিযোগে বলা হয়েছিল, পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে সজলকে গুলি করা হয়। রাত ১১টা নাগাদ সজলবাবুকে গুলি করা হয় বলে অভিযোগ হলেও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, খুন হয়েছিল সম্ভবত সন্ধ্যায়। ওই সময়ে হাসপাতালের সিঁড়িতে শুয়ে থাকা রোগীর আত্মীয়স্বজন বা উল্টো দিকে ওষুধের দোকানের কোনও কর্মীকেও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজির করতে পারেনি পুলিশ।
প্রদীপ সাহার অন্যতম আইনজীবী তথা সিপিএম নেতা সামসুল ইসলাম মোল্লা বলেন, “রাত ১১টা নাগাদ সজল ঘোষ খুন হন বলে অভিযোগ। অথচ পরের দিন সকাল ৯টা নাগাদ ময়নাতদন্ত করে চিকিৎসক জানালেন, অন্তত ষোল থেকে আঠারো ঘণ্টা আগেই মৃত্যু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, সজলবাবু গুলি খেয়ে পড়ে যেতেই তাঁরা তাঁকে তুলে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে যান এবং ডাক্তারবাবু তাঁকে ‘মৃত’ ঘোষণা করেন। কিন্তু ওই রাতে হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক পবিত্রকুমার করণ সাক্ষ্যে বলেছেন, দেহ পরীক্ষার সময়ে সজল ঘোষের বুকের ব্যান্ডেজ সরিয়ে গুলির আঘাত দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। সজলবাবুর বুকে ওই সময়ের মধ্যে ব্যান্ডেজ এল কোথা থেকে?”
২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি ঘটনার রাতে যিনি সজলবাবুর সঙ্গেই হাসপাতালে গিয়েছিলেন বলে দাবি, সেই পূর্বস্থলী উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পাল্টা বলেন, “অতগুলো লোকের সামনে খুন হল, সেটা মিথ্যা হয় না কি? ওরা টাকা দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত করেছে। সুবিচার চেয়ে উচ্চতর আদালতে যাব।” আবার সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল সম্পাদক সুব্রত ভাওয়ালও বলেন, “দলের তরফে সজল ঘোষের দাদার কাছে আবেদন জানানো হবে, যাতে তিনি উচ্চ আদালতে গিয়ে বিচার চান। ওঁরা তো জানতেই পারলেন না, আসল খুনি কে!”
সামসুল ইসলামের দাবি, “সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখে আমাদের মনে হয়েছে, কোনও দক্ষ বন্দুকবাজ গুলি করেছিল। সেই বন্দুকবাজের হদিস চাই। কে তাকে গুলি কারার নির্দেশ দিয়েছিল তা-ও জানতে হবে।” প্রদীপবাবু বলেন, “পুলিশ তো নয়ই, সিআইডি-তেও আমাদের ভরসা নেই। তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। সিবিআই চাই। প্রয়োজনে মামলা করব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy