স্থান বদল। বক্তৃতা দিয়ে জায়গায় ফিরছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন বিমান বসু। শুক্রবার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের বিক্ষোভ মঞ্চে প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।
নবান্নের কূটনীতি-পর্ব এখন অতীত। শাসক দলের কাছে আত্মসমর্পণের কোনও প্রশ্নই নেই বলে এ বার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে প্রথম বার প্রকাশ্যে মুখ খুলে দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি তাঁর বার্তা, এক দিকে তৃণমূল এবং অন্য দিকে বিজেপি জোড়া বিপদের মোকাবিলায় রাস্তায় নামাই একমাত্র রাস্তা। কিন্তু কলকাতায় বামেদের তিন দিনের অবস্থান কর্মসূচির যে মঞ্চ থেকে বুদ্ধবাবুর শুক্রবার এমন বার্তা, সেই মঞ্চেই গুরুতর প্রশ্ন থেকে গেল সিপিএম-সহ বামেদের জন্য!
লোকসভা ভোটে বেনজির ভরাডুবির পরেই সিপিএম-সহ নানা বাম শরিক দলের অন্দরে নেতাদের একাংশ সরব হয়েছেন নেতৃত্ব বদলের দাবিতে। সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে মানব মুখোপাধ্যায়, মইনুল হাসান বা অমল হালদারের মতো একাধিক নেতা দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতাদের দিকে আঙুল তুলেছেন। ফরওয়ার্ড ব্লকে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন হাফিজ আলম সৈরানি, উদয়ন গুহ বা যুব নেতা অনির্বাণ চৌধুরী, অজয় অগ্নিহোত্রীরা। এঁরা কেউই অবশ্য দলের সদস্যপদ এখনও ছাড়েননি। দলের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে হোক বা বামফ্রন্টের আলোচনায়, বাম নেতাদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কেন রাজ্য নেতৃত্ব পথে নামছেন না? অথচ পথে নেমে রাত জাগার কর্মসূচিতে দেখা গেল মানব, মইনুল, অমল বা তড়িৎ তোপদারেরা শুধু হাজিরা দিয়েছেন মাত্র! রাত জাগার সময় ভরসা এখনও সেই বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, ক্ষিতি গোস্বামী, মঞ্জুকুমার মজুমদার বা জয়ন্ত রায়েরা! দলের মধ্যে যাঁরা হামেশাই আক্রমণের নিশানায়!
বিমানবাবু, সূর্যবাবু যেমন টানা দু’রাত রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের ধর্নাস্থলেই কাটিয়েছেন, তেমনই পর্যায়ক্রমে তাঁদের সঙ্গী হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মদন ঘোষ, নৃপেন চৌধুরী, শ্রীদীপ ভট্টাচার্যেরা। নিকট আত্মীয় বিয়োগের আগে প্রথম রাত জেগেছেন রবীন দেব, শ্মশানের কাজ মিটিয়ে পর দিন ফিরেও এসেছেন। সুজন চক্রবর্তী, সুদর্শন রায়চৌধুরী, অমিয় পাত্রের মতো জেলা সম্পাদক, সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, যুব নেতা আভাস রায়চৌধুরী, সায়নদীপ মিত্র, পলাশ দাস, ছাত্র-নেতা দেবজ্যোতি দাস, মধুজা সেনরায়দেরও রাত জাগতে দেখা গিয়েছে। পুত্র সপ্তর্ষি রাস্তায় রাত কাটালেও দেখা যায়নি গৌতম দেবকে। শরিক আরএসপি-র তরফে মনোজ ভট্টাচার্য, সুকুমার ঘোষ, মৃন্ময় সেনগুপ্ত, ফ ব-র নরেন চট্টোপাধ্যায়, জীবন সাহা, দেবব্রত রায়, সৌম্যদীপ সরকার বা সিপিআইয়ের প্রবীর দেবেরাও এক রাত করে অবস্থানে কাটিয়েছেন। মানববাবুদের সেই তালিকাতেও ফেলা যাচ্ছে না!
ধর্নায় সকলে যাতে জেগে থাকেন, তার জন্য উদ্যোগী হতে দেখা গিয়েছে বিমানবাবু, সূর্যবাবুদেরই। দলের বাকিরা কী করলেন, এই প্রশ্নের জবাবে দু’জনেই অবশ্য বলছেন: কারা রাত জাগবেন, তা আলোচনা করেই ঠিক হয়েছিল। জাগতে বলা হলে অন্যেরাও নিশ্চয়ই তা-ই করতেন। তাতে অবশ্য প্রশ্ন থামছে না! আলিমুদ্দিনে আজ, শনিবারই রাজ্য কমিটির বৈঠকে তিন দিনের এই অবস্থান কর্মসূচির পর্যালোচনা হওয়ার কথা। সেখানেও এমন প্রশ্ন ওঠা অপ্রত্যাশিত নয়।
অবস্থানের শেষ দিনে বুদ্ধবাবু বলেছেন, “তৃণমূল ভাবছে হাঙ্গামা করে বিরোধীদের চুপ করিয়ে দেবে! কিন্তু আমরা কোনও অবস্থাতেই আত্মসমর্পণ করব না। মাথা নিচু করব না! এই যুদ্ধে যত দূর যেতে হয়, আমরা যাব!” লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রতিরোধের ডাক দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যে শাসক দলের সন্ত্রাস রুখতে পারেননি সর্বত্র, তা মেনে নিয়েই সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্যের বক্তব্য, “আনুষ্ঠানিক ভাবে এই অবস্থান এখানে শেষ। কিন্তু জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে এই কর্মসূচি আপনাদের ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারের অন্যায়, জিনিসপত্রের দাম, সব নিয়েই আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে।” নানা জেলা থেকে আসা আক্রান্ত বাম পরিবারের মানুষজন সোৎসাহে সমর্থন জানিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে।
লোকসভা ভোটের পরে রাজ্যে বিজেপি-র উত্থানের কথাও এ দিন স্বীকার করে নিয়েছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, “এ রাজ্যে বিজেপি বিরোধী দলের জমি দখল নিতে চাইছে।” পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর আহ্বান, “রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মাটিতে আরএসএসের লাঠি ঘুরবে, এটা কখনও হতে পারে? বামপন্থী হিসাবে এ জিনিস রুখতে হবে।”
শারীরিক কারণেই রাত জাগেননি বুদ্ধবাবু। যদিও শরীরের কারণে কত দিন কত কর্মসূচি তাঁকে এড়িয়ে চলতে হবে, এই প্রশ্নও দলের একাংশে আছে। তবে এ সব ছাপিয়ে তিন দিনের বেনজির ধর্নার প্রধান কারিগর হিসাবে উঠে এসেছেন সেই বিমানবাবুই। লোকসভা ভোটে পরাজয়ের পরে যিনি দলেই প্রবল চাপের মুখে! আক্রান্তদের সমর্থন কুড়িয়ে ধর্না শেষ করার সময় যিনি এ দিন ডাক দিয়ে দিয়েছেন, “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! এই হোক আমাদের মন্ত্র!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy