Advertisement
E-Paper

হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে ‘প্যার’

দুপাশে ঝোপজঙ্গল। বুক চিরে ভাঙাচোরা রাস্তা। যত দূরেই যাই, কোথাও কোনও জনমনিষ্যির দেখা নেই। এ দিক-ও দিক কয়েকটি পাকা বাড়ি রয়েছে বটে, কিন্তু মহামারী আক্রান্ত পাড়ার মতো সেগুলিও খাঁ খাঁ। চলমান প্রাণী বলতে কয়েকটি গরু আর ধুলো শোঁকা কুকুর। পরিত্যক্ত চায়ের দোকানের ফাটল ধরা উনুনে শেষ কবে আগুন জ্বলেছে, কে জানে! চারপাশে কেমন অশরীরী নীরবতা!

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০২:৩৮

দুপাশে ঝোপজঙ্গল। বুক চিরে ভাঙাচোরা রাস্তা। যত দূরেই যাই, কোথাও কোনও জনমনিষ্যির দেখা নেই। এ দিক-ও দিক কয়েকটি পাকা বাড়ি রয়েছে বটে, কিন্তু মহামারী আক্রান্ত পাড়ার মতো সেগুলিও খাঁ খাঁ। চলমান প্রাণী বলতে কয়েকটি গরু আর ধুলো শোঁকা কুকুর। পরিত্যক্ত চায়ের দোকানের ফাটল ধরা উনুনে শেষ কবে আগুন জ্বলেছে, কে জানে! চারপাশে কেমন অশরীরী নীরবতা!

মে দিবসের সকাল। ১৯৯০-তে পত্তন হওয়া আসানসোলের কন্যাপুর শিল্প তালুকে ‘মহান শ্রমিক দিবস’-এর উদ্যাপন খুঁজতে গেলে এমন অভিজ্ঞতাই যে হবে, তা কানে এসেছিল। গিয়ে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করা গেল। উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে একের পর এক চালু কারখানা এখান থেকে ঝাঁপ গুটিয়েছে, আঙুলে গোনা যে দু’-চারটি আছে তারাও ধুঁকছে। কীসের শ্রমিক দিবস!

সেন-র্যালের বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত সাইকেল কারখানার চৌহদ্দিতেও শ্মশানের শূন্যতায় ভরা একই ছবি। আপাতত এটি আদালতের এক্তিয়ারে। কিন্তু সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থার সুযোগে মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। পাঁচিলের ইট পর্যন্ত লোপাট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। চট করে দেখলে মনে হয়, যেন খনন করে পাওয়া কোনও পুরনো সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ। বিবিধ কারণে বন্ধ পড়ে আছে পিলকিংটনের কাচ কারখানা, রেকিট-কোলম্যানের রবিন ব্লু কারখানা, বালকো এমন আরও কত! কর্মহীন শ্রমিকদের হাহাকারে ভারী হচ্ছে বাতাস। সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক চাপানউতোর।

তবু আসানসোলকে শিল্পাঞ্চল বলেই চেনানো হয়। এখানে ভোট লড়তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা থেকে পাঠিয়েছেন তাঁর দলের শ্রমিক সংগঠনের প্রধান দোলা সেনকে। দিদির নির্দেশে শাড়ি পরে ঘাগড়বুড়ি এবং কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন দোলা।

এক সময় অতি-বামপন্থী রাজনীতি করলেও দীর্ঘদিন মমতার পাশে থেকে নিজের ‘আনুগত্য’ প্রমাণ করতে পেরেছেন দোলা সেন। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তাঁর ভূমিকায় মমতা যারপরনাই ‘খুশ’ হন। ক্রমে দোলার রেখচিত্র ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। এখন তো তিনি আক্ষরিক অর্থেই হেভিওয়েট! এতটাই যে, তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়নে বক্সিং জানা প্রবীণ নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কেও দোলা অনায়াসে রিংয়ের বাইরে ফেলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছেন!

কিন্তু সেই দোলাকে আসানসোল থেকে জেতানোর চ্যালেঞ্জ নিতে তাঁর দল কতটা স্বচ্ছন্দ? কেন মুখ্যমন্ত্রী এই কেন্দ্রে চারবার প্রচারে এলেন? শেষ দফা নির্বাচনী প্রচারে এসে কেন প্রকাশ্যে দলীয় ঐক্যের ডাক দিতে হল স্বয়ং মমতাকে? কেনই বা বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে আপাত-ভিত্তিহীন একের পর এক অভিযোগ তুলে তাঁকে পুলিশ দিয়ে নাজেহাল করার পথে গেল তৃণমূল? তবে কি মোদী হাওয়ার চাপ বাড়ছে? তবে কি ভোট কাটাকাটিতে ফের গড় ধরে রাখতে পারেন সিপিএমের বংশগোপাল চৌধুরী?

এতগুলি প্রশ্নচিহ্ন যাঁর মাথায় খাঁড়ার মতো ঝুলে, ভোট-বৈতরণী পেরোতে নেমে চোরাস্রোত তিনি টের পাচ্ছেন নাতা হয় নাকি! তার উপর আবার এখন থেকেই তিনি দাবি করতে শুরু করেছেন, জেতার পরে আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ আড্ডা-র মাথাতেও না কি তিনিই বসবেন। অতএব সমস্ত ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ’ বিবেচনা করে কোনও বিচারকই হয়তো দ্বিধাহীন প্রত্যয়ে বলতে চাইবেন না, তাঁর মামার বাড়ির দেশ আসানসোলে এসে দিদির স্নেহধন্যা দোলা ভারী মজায় আছেন! দোলা তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর নিজের পাড়া বাগুইহাটি-কেষ্টপুরের ‘ভাই’দের।

এস বি গরাই রোডে তাঁর ভাড়া নেওয়া তিনতলা বাড়ির দোতলায় প্রশস্ত হলঘরে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ঢালাও আয়োজন। তৃণমূল প্রার্থীর জন্য রাস্তা ভরানো ‘মহামিছিল’ করতে কলকাতা থেকে বেশ কিছু বাস রিজার্ভ করে ছেলের দল গিয়েছে, নজির মিলল তারও।

তবে কি না দোলা সেন ডাকাবুকো লড়াকু বলে খ্যাত। ভাঙলেও মচকাতে চান না। তাই মন্ত্রী মলয় ঘটক, তস্য ভ্রাতা দোর্দণ্ডপ্রতাপ মেয়র পারিষদ অভিজিৎ, বিধায়ক এবং আড্ডা-র চেয়ারম্যান নিখিল মুখোপাধ্যায়, বারাবনির বিধায়ক বিধান উপাধ্যায়, আসানসোলের মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার মিটিং করে বেরিয়েই পরম আত্মবিশ্বাসে হাসিমুখে তিনি বলতে পারেন, “এই তো দেখলেন, সবাই মিলে বসে আলোচনা করে কাজ করছি। কে বলল প্রবলেম! দিদি আমাদের আরও একটু চাঙ্গা করার জন্যই সবাইকে কোমর বেঁধে নামতে বলে গেলেন। আর বিজেপি? সে তো মিডিয়ার তৈরি করা ভূত! উড়ে যাবে, উড়ে যাবে।”

সত্যিই উড়ে বেড়াচ্ছেন বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় ওরফে সুপ্রিয় বড়াল। পেশাদার রাজনীতির লোক না হয়েও নির্বাচনী কেন্দ্রের এ মুড়ো-ও মুড়ো চষে ফেলতে যিনি অক্লান্ত। রানিগঞ্জের বণিকসভায় লম্বা বৈঠক সেরে বিবেকানন্দ সেবাকেন্দ্রের মাঠে পৌঁছতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল তাঁর। পথের ভিড়ে বিশেষ করে অল্পবয়সির দল বারবার তাঁর গাড়ির পথ আগলায়। ঝটপট অটোগ্রাফ বিতরণ, কখনও গাড়ির পাদানিতে দাঁড়িয়ে মুখ দেখাতে হয়, কোথাও তারই সঙ্গে শোনাতে হয় এক কলি ‘কহো না প্যার হ্যায়’। গলদঘর্ম বাবুল সুপ্রিয় বললেন, “জানেন, এত বছর স্টেজ শো করতে করতে ক্রাউড ম্যানেজমেন্টটা আমি শিখে গিয়েছি। এটা আমি নিজেই করি।”

হলও তাই। সভাস্থলে তাঁকে ঘিরে প্রবল হুড়োহুড়ি। টুপি পরা বিজেপি স্বেচ্ছাসেবকদের মানবশৃঙ্খল ভেঙে ছত্রখান। বাবুল লাফিয়ে এসে ঘোষককে সরিয়ে নিজে মাইক ধরলেন। ঠিক মমতার কায়দায় মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ এ বার তাঁর হাতে: “এই, তুমি বসো তো! ওই যে ও দিকে ওই টুপি পরা ছেলে, সামনে থেকে সরবে কি না! কে ওখানে আটকাচ্ছে? ছেড়ে দাও ওদের। আমি বলছি ছেড়ে দাও...” ইত্যাদি নির্দেশে প্রায় নেতার ধমকের মতোই কাজ হল।

বাবুল জানেন, সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তা এই উন্মাদনার একটি উপাদান। আবার এটাও বিশ্বাস করেন, তাঁর চেনামুখ বিজেপি-র চলতি হাওয়াকে আরও জোরালো করে দিচ্ছে। যেটা তাঁর বাড়তি পাওনা। তাঁর কথায়, “আমি রাজনীতি থেকে উঠে আসিনি। ভোটের জটিল অঙ্কও বুঝি না। তবে মঞ্চের শিল্পী হিসাবে মানুষের মনোভাব বুঝতে পারি। আর পারি চ্যালেঞ্জ নিতে। বিদেশি ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে গানের জগতে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে যে দিন মুম্বই গিয়েছিলাম, ভয় পাইনি। আজও পাই না। আমার কাছে এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। লড়ে নেব। কেউ অকারণে ঘুষি মারলে পাল্টা দেব।”

প্রতিপক্ষ কে? বাবুলের বিচারে “আসল অবশ্যই তৃণমূল। দেখছেন না, কারা আমাকে কী ভাবে হেনস্থা করার চক্রান্ত করেছে!” মুখ্যমন্ত্রী চারবার প্রচারে এসেছেন এই কেন্দ্রে। বাবুল তাই ‘দিদির কাছে কৃতজ্ঞ’ “তিনি আমাকে সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে স্নেহ করেন, ভালবাসেন। এ বার এই ময়দানেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটা তো অ্যাকনলেজমেন্ট! আমাকে হেনস্থা করা, আমার কেন্দ্রে দিদির বারবার আসা, এতে কী বোঝায়? আমি আছি, আমরা আছি, বিজেপি আছে এবং আমরাই জিতব।”

তবু দিদির জন্য একটি বার্তা আছে তাঁর। কী? বাবুল বলেন, “দেখা হলে দিদির কাছে জানতে চাইব, না হয়, অন্য দলের হয়ে আপনার দলের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছি। নীতির লড়াই লড়ুন। তার জন্য ব্যক্তিগত কুৎসা ছড়ানো? আপনি তো আমাকে চেনেন, জানেন। ভালবেসেছেন শিল্পী হিসাবে। আজ তুচ্ছ রাজনীতির জন্য এই নোংরা ব্যক্তিগত আক্রমণ কি আমার প্রাপ্য ছিল!”

চায়ের ভাঁড়ে শেষ চুমুক দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী।

debashis bhattacharya election at asansol
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy