শহরের এক প্রান্তের গাছতলায় মিটিং চলছে বন্ধুদের। বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন বছর বাইশের তরুণী। তখনই বাড়ি যেতে চান। কিন্তু তাঁর উপরে যে অনেক কাজের দায়িত্ব! ফলে বাকিরা হতবাক। তরুণী নেত্রীর মুখ যেন ততই শুকিয়ে যায়।
ঋতুস্রাব।
সমস্যাটা ওইটুকুই।
হঠাৎ ঋতুস্রাব যে শুরু হতে পারে, তার জন্য তৈরি ছিলেন না তিনি। কোনও একটি শৌচাগারে ঢুকে একটু প্রস্তুত হয়ে আসতে হবে তাঁকে। কিন্তু জনসমক্ষে এ কথা কি বলা যায়? এ শহর যে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ‘মেয়েদের শরীর খারাপ’ নিয়ে আড়ষ্টতা, মনে করান সেই দলেরই আর এক তরুণী। অন্তরা গোস্বামী নামে দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রী বলেন, ‘‘কাউকে তো বলা যায় না। রাস্তায় হঠাৎ শরীর খারাপ হলে তাই খুব সমস্যায় পড়ি। কোন দিকে যে গেলে সুবিধে হবে, এক-এক বার তা-ই বুঝে পাই না।’’
ঋতুস্রাবকে শরীর খারাপ বলা হবে কেন? প্রশ্ন তুললেন আর এক কলেজছাত্রী। ‘‘পিরিয়ড হলে সেইটাই বলব। আমরাই যদি আমাদের কথা বলতে না পারি, তবে লোকেই বা ভাববেন কেন?’’ বক্তব্য অন্নপূর্ণা হালদার নামে ওই তরুণীর। এ কথার সঙ্গে একমত তাঁর শিক্ষিকা রুমেলা মল্লিক। বছর পঁয়ত্রিশের রুমেলার বক্তব্য, ঋতুস্রাব নিয়ে সঙ্কোচ যত দিন না কাটবে, তত দিনে বাস্তব প্রয়োজনের জায়গাগুলো তুলে ধরাও মেয়েদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
তবে এমনও নয় যে, আড়ষ্টতা কাটানোর চেষ্টা কখনওই করা হয়নি। ঋতুস্রাব নিয়ে ছুতমার্গ কাটাতে সম্প্রতি স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপরে লিখে সচেতনতা প্রচার চালিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। কর্মরত মহিলাদের ‘পিরিয়ড লিভ’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে এ শহরেরই একটি বেসরকারি সংস্থা। তবে এ সবই বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা মাত্র। ঋতু-সঙ্কোচ কাটাতে সার্বিক ভাবে কোনও প্রচার এখনও দেখেনি এ শহর।
এ দিকে স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ঋতুমতীদের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রয়োজন। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সেটি গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করাচ্ছেন, ‘‘রাস্তাঘাটে পরিষ্কার শৌচালয় না পেয়ে মেয়েরা অনেক সময়ে বাধ্য হন দিনভর শৌচালয় না ব্যবহার করতে। সেটা শরীরের জন্য বিশেষ ভাবে খারাপ।’’ সঙ্কোচ কাটিয়ে নিজেদের প্রয়োজনের কথা তাই বারবার জনসমক্ষে আনার প্রসঙ্গই উঠে আসছে।
বস্তুত, এ শহরের পথে চলাফেরার ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের অভাবে মহিলাদের যে অসুবিধায় পড়তে হয়, সে কথা জানেন অনেকেই। ঋতুস্রাবের সময়ে রাস্তাঘাটে কোথাও সমস্যায় পড়লে একটি পরিষ্কার শৌচাগার পেতেই কেটে যায় সময়। সঙ্গে যদি না থাকে নিজস্ব স্যানিটারি ন্যাপকিন-ট্যাম্পুন বা মেন্সট্রুয়াল কাপ, তবে তো কথাই নেই। তা কিনতে যেতে হবে যে কোথায়, তা-ও আর এক চিন্তার। অথচ বিদেশের যে কোনও বড় শহরের ব্যস্ত জায়গায় অত্যন্ত সচেতন ভাবেই পরিষ্কার শৌচালয়ের ব্যবস্থা রাখে স্থানীয় প্রশাসন। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির প্রতিটি বাস-রেলস্টেশনে মহিলাদের জন্য শৌচালয় তো বটেই, থাকে টয়লেট সিট স্যানিটাইজারও। এমনকি, ছোট্ট দেশ কাম্বোডিয়ার বিভিন্ন শহরে পাবলিক টয়লেটের পরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ার মতো।
ইতিমধ্যেই কলকাতার শৌচালয়-সংস্কৃতিতে একটু বদল আনতে বিভিন্ন পাবলিক টয়লেটে স্যানিটারি প্যাড রাখার ব্যবস্থা করেছেন তরুণ ছাত্র শোভন মুখোপাধ্যায়। অন্তত কোনও কোনও পাবলিক টয়লেটে যাতে সুস্থ পরিবেশ পান মহিলারা, তার জন্য করে চলেছেন পরিশ্রম। তিনি বলেন, ‘‘আরও অনেক কাজ বাকি। তবে আমি যতটুকু করি, তাতে কিছুটা হলেও সচেতনতা তো বাড়বে শহরের অন্যদের মধ্যে।’’
সচেতনতা যে বেড়েছে, তা শোভনের অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট। তিনি যে বিভিন্ন শৌচাগারে গিয়ে নিজ উদ্যোগে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার কাজ করবেন, তা আত্মীয়বন্ধুরা কী ভাবে দেখবেন, কিছুটা চিন্তা ছিল প্রথমে। তবে তা কেটেছে তাঁর পরিজনেরা সাহস দেওয়ায়। তাঁরাও বরং অনেকে এগিয়ে এসেছেন শোভনের কাজে হাত লাগাতে। শহরের বিভিন্ন বস্তি এবং কলকাতার কাছাকাছি কিছু গ্রামে এ বার থেকে বড় দল তৈরি করে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেবেন ওঁরা। দলের প্রত্যেক সদস্য এর জন্য দিনে দু’টাকা করে ব্যয় করবেন বলে ধার্য হয়েছে। শোভন বলেন, ‘‘দশ জন করে দল হচ্ছে। মাসে ৬০০ টাকা উঠে যাবে এক-একটি দল থেকে। সেই টাকায় কত মহিলা পরিষ্কার স্যানিটারি প্যাড পেতে পারেন ভাবুন! আমরা পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করব।’’ সঙ্কোচ কাটিয়ে শহরের মানুষকে এগিয়ে আসতে ডাক দিয়েছেন শোভন। সকলে মিলে যাতে আরও একটু সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা যায় মেয়েদের জন্য, সেটাই লক্ষ্য।
ঋতুস্রাব সংক্রান্ত সঙ্কোচ কাটানোর বার্তা দিয়ে বিশ্বজয় করে এসেছে এ দেশের তথ্যচিত্র ‘পিরিয়ড. এন্ড অব সেন্টেন্স.’। এ বার নাগরিকদের এগিয়ে আসার পালা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy