Advertisement
E-Paper

মধ্য এশিয়ায় প্রতিপত্তি হারাচ্ছে আমেরিকা, ট্রাম্পের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ

মধ্য এশিয়ায় থেকে আমেরিকার ছায়া কি ক্রমেই সরে যাচ্ছে? প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে মার্কিন কূটনীতি। ২০১৬-এর প্রেক্ষিতে প্রশ্নটির উত্তর, হ্যাঁ। সিরিয়ায় চার বছর পর গত কাল, বুধবার, আলেপ্পো আবার চলে এসেছে আসাদ বাহিনীর হাতে।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৩:৪০

মধ্য এশিয়ায় থেকে আমেরিকার ছায়া কি ক্রমেই সরে যাচ্ছে? প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে মার্কিন কূটনীতি। ২০১৬-এর প্রেক্ষিতে প্রশ্নটির উত্তর, হ্যাঁ। সিরিয়ায় চার বছর পর গত কাল, বুধবার, আলেপ্পো আবার চলে এসেছে আসাদ বাহিনীর হাতে। আমেরিকার না-পসন্দ এই বাশার আল-আসাদকে পূর্ণ মদত দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। আলেপ্পো ‘উদ্ধার’ যখন হব হব করছে, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে গত মঙ্গলবার মস্কোয় রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের বিদেশমন্ত্রীরা বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে আমেরিকাকে আমন্ত্রণই করা হয়নি। আমন্ত্রণ করা হয়নি রাষ্ট্রপুঞ্জকেও। এই বৈঠক নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বিদেশ সচিব জন কেরি রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী ও তুরস্কের বিদেশ সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার পরেও বৈঠক হয়েছে।

খুব পিছিয়ে না গিয়ে, গত দু’দশকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতির দিকে যদি তাকানো যায়, তবে ‘সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা’ আমেরিকার উপস্থিতি জ্বলজ্বল করছে। সব সঙ্কটে জড়িয়ে আছে আমেরিকা। এমনকী আমেরিকাকেই বেশ কয়েকটি সঙ্কটের জনক বলা চলে। সেই আমেরিকাকে বাদ রেখেই সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হচ্ছে। এবং এটা নিশ্চিত যে মস্কোর এই বৈঠক সিরিয়ায় আসাদের ক্ষমতাকে আরও শক্ত করতেই। পাঁচ বছর আগে যাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করার ডাক দিয়েছিলেন বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

পরিবর্তনের ডাক দিয়ে ২০০৮-এ ক্ষমতায় এসেছিলেন ওবামা। সেই পরিবর্তনের অংশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে আনা, ‘ব্রিং আওয়ার বয়েজ ব্যাক’। গত আট বছরে দু’টি কথা রেখেছেন ওবামা। কিন্তু ইরাকে মার্কিন সেনা সরে আসায় ক্ষমতার শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। সেই জায়াগা দখল করে নিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের ক্ষমতার আধিপত্য। এই আধিপত্য ক্রমাগত বিছিন্ন করেছে সংখ্যালঘু সুন্নিদের। ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ যখনই সুন্নিদের সামনে শিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছে তা সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি সুন্নিদের একাংশ। পিছনে জনসমর্থন না থাকলে ইসালিমক স্টেটের (আইএস) ঝড়ের মতো উত্থান সম্ভব হত না। ওবামা ও ভাবে ইরাক থেকে তাড়াহুড়ো করে মার্কিন সেনা সরিয়ে না নিলে হয়ত আইএস-এর ঝড়কে প্রথমেই সামাল দেওয়া যেত।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আসলে ওবামার সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিল। পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী শিয়া-সুন্নি অক্ষের মধ্যে দিয়ে শান্তির পথ তৈরি করা। কিন্তু সেই পথ তো তৈরি হয়ইনি। উল্টে মার্কিন কূটনীতির খামতি প্রকাশ পেয়েছে। ২০১১-তে সিরিয়ার গণবিক্ষোভ এবং আসাদের কঠোর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ওবামা, আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন। কিন্তু সেই কাজে মার্কিন সেনাকে সরাসরি নিয়োগ করা, যেমন সাদ্দামকে উৎখাত করতে বুশ করেছিলেন তা স্বপ্নেও ভাবেননি ওবামা। শুধু বিদ্রোহীদের অস্ত্র, অর্থ জোগানের পথেই হেঁটেছে আমেরিকা। আমেরিকার এই দোনামনা চিরাচরিত বন্ধু সুন্নি প্রধান সৌদি আরব, কাতারকে হতাশ করেছে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ধাত্রীভূমিতে আইএস-এর উত্থান আমেরিকার নীতি নির্ধারণকে আরও জটিল করে তুলেছে। এক দিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে জোট তৈরি করা। অন্য দিকে আসাদ বিরোধিতার ধার বজায় রাখা। প্রথম লক্ষ্যের জন্য ইরাকের শিয়া-শাসক আর ইরানের সাহায্য দরকার। যে নৈকট্য সৌদি আরবকে শঙ্কিত করেছে। আবার আসাদের বিরুদ্ধে গেলে সেই ইরানের সঙ্গেই ছায়া যুদ্ধ করার দরকার।

ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই ইরানের সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের পারমাণবিক সমঝোতা হয়। যার অন্যতম উদ্যোক্তা আমেরিকা। এটি ওবামাকে দু’টি দিক থেকে বিছিন্ন করে দেয়। সুন্নি ব্লকের নেতা সৌদি আরব এই সমঝোতার তীব্র বিরোধী। ফলে আমেরিকার সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক শীতল হয়। পাশাপাশি ‘চিরসখা’ ইজরায়েলও এই সমঝোতার কট্টর বিপক্ষে। দীর্ঘ দিন ধরে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে বাগড়া দিয়ে এসেছে ইজরায়েল। তা ছাড়া ইজরায়েলের গাজায় শেষ অভিযানের সময়ে আমেরিকা সে ভাবে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি বলেও অনুযোগ ছিল। ফলে আমেরিকার ‘আমও গেল, ছালাও গেল’ দশা। মার্কিন সেনাকে সরাসরি যুদ্ধে নামানোর ক্ষেত্রে ওবামার দোনামনাও মধ্য এশিয়ার দেশগুলি ভাল ভাবে নেয়নি।

মধ্য এশিয়ার বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের চিড় ধরে ‘আরব বসন্ত’-এর সময়ে। এই সব দেশের শাসকরা বিস্মিত হয়েছিলেন যখন দীর্ঘ দিনের সহযোগী মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক ক্ষমতাচূত্য হওয়ার সময়ে আমেরিকা নিস্পৃহ ছিল। তাদের বিপদ হলেও আমেরিকা একই আচরণ করবে কি না, তা নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ইরানের সঙ্গে সমঝোতা সেই শঙ্কাকে আরও বাড়ায়।

নানা দোনামনা করে শেষ পর্যন্ত আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে আমেরিকা। তাও শুধু বায়ুসেনা আর স্পেশ্যাল অপারেশন টিমকে ব্যবহার করে। প্রধান যুদ্ধ করবে ইরাকি সেনা, শিয়া মিলিশিয়া আর কুর্দ পেশমেরগা যোদ্ধারা। তথ্য জোগাবে আমেরিকা। বিমানহানায় সঙ্গে অবশ্য ফ্রান্স, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, আর তুরস্ক।

কুর্দদের সঙ্গে আবার তুরস্কের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। তুরক্সের এক অংশে স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে লড়ছে কুর্দরা। সেই কুর্দদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে তুরস্কের আপত্তি ছিল। ফলে তুরস্কের থেকেও সে ভাবে সহযোগিতা পায়নি আমেরিকা। আর সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরে আমেরিকার আশ্রয়ে থাকা তুর্কি নেতা গুলেনকে ফিরে পেতে আমেরিকার উপরে চাপ বাড়ান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। আমেরিকা রাজি হয়নি। ফলে দু’দেশের বিশ্বাসে ভাঙন ধরেই ছিল।

তার উপরে প্রবল ভাবে জুড়ে গেল রাশিয়া ফ্যাক্টর। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ পুরো ছকটিকেই বদলে দেয়। ওবামার কৌশলকে কফিনবন্দি করে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগে রাশিয়া আর ইরানের সাহায্যে আলেপ্পোর দখল নিয়ে ফেলেছে আসাদের সেনা। আইএস ছাড়া সিরিয়ায় আর কোনও আসাদ-বিরোধী শক্তি বেঁচে নেই। যে তুরস্ক এত দিন আসাদের বিরোধিতা করে এসেছে, মস্কোর বৈঠকে অংশ নিয়ে সেই তুরস্কও যত সম্ভব সিরিয়ায় আসাদের অবস্থানকে মেনে নেবে।

সব মিলিয়ে বছরের শেষে দেখা যাচ্ছে, এক দিকে পুরনো বন্ধুদের হারিয়েছে আমেরিকা। অন্য দিকে নতুন বন্ধুও জোটেনি। আমেরিকা মধ্য এশিয়ায় তার বন্ধুদের কাছেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। ট্রাম্প কি পারবেন সেই বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরাতে? বিদেশ সচিব পদে টিলারসনকে বেছে নেওয়ার মধ্যে সেই ইঙ্গিতই রয়েছে। ‘এক্সনমোবিল’-র কর্তা টিলারসনের মধ্য এশিয়ায় শক্তিগুলির সঙ্গে দর কষাকষিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের যথেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ টিলারসন। দু’য়ে মিলে মধ্য এশিয়ার জন্য নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতেই হবে ট্রাম্পকে। না পারলে, যেটুকু প্রভাব এখনও অবশিষ্ট তাও খোয়াতে হবে।

আরও পড়ুন: লরি হামলা তাদেরই কাজ, দাবি আইএসের

আরও পড়ুন: আইএস এঁর মাথার দাম রেখেছে ১০ লক্ষ ডলার

Syria USA Donald Trump Barack Obama Middle East
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy