Advertisement
E-Paper

মাইনাস পঁচিশে এখন আর আঁতকে উঠি না

প্রথম যখন এ দেশে পা দিই, মরু-ঘূর্ণাবর্ত বা পোলার ভর্টেক্স কথাটার মানেও জানতাম না। কবে শব্দটা প্রথম শুনেছি, তা মনে না পড়লেও হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রার সঙ্গে প্রথম মোলাকাতের কথা দিব্যি মনে আছে।

পলি গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৩
কনকনে: রেললাইনের বরফ গলাতে জ্বালানো হয়েছে আগুন। বৃহস্পতিবার শিকাগোয়। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া

কনকনে: রেললাইনের বরফ গলাতে জ্বালানো হয়েছে আগুন। বৃহস্পতিবার শিকাগোয়। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া

বড় হয়েছি গ্রীষ্মপ্রবণ ভারতবর্ষে। কর্মসূত্রে বাবা কিছু দিন উত্তর ভারতে ছিলেন। শীতকালে তখন মনটা কলকাতার জন্য পালাই পালাই করত। তখনও জানি না, আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে মেরু-ঘূর্ণাবর্ত।

প্রথম যখন এ দেশে পা দিই, মেরু-ঘূর্ণাবর্ত বা পোলার ভর্টেক্স কথাটার মানেও জানতাম না। কবে শব্দটা প্রথম শুনেছি, তা মনে না পড়লেও হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রার সঙ্গে প্রথম মোলাকাতের কথা দিব্যি মনে আছে।

বছর কুড়ি আগের কথা। তখনও হাতে হাতে স্মার্টফোন আসেনি। ফেসবুক-হোয়াটস্যাপও আসেনি। কাল কী রকম আবহাওয়া থাকবে, ঠান্ডা থেকে বাড়ির বয়স্ক ও বাচ্চাদের বাঁচাতে কী কী করা উচিত, তা নিয়ে রাশি রাশি ‘ফরোয়ার্ড’ও আসত না। প্রথম শীতে প্রতি পদে ঠেকে শিখেছি, কী ভাবে এখানে বাঁচতে হবে। তখন ম্যানহাটনের একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। কাঁপতে কাঁপতে ‘থার্মোস্ট্যাট’ চালিয়েছি, ঘর যতটা সম্ভব বেশি গরম রাখা যায়। পরের দিন নাক থেকে রক্ত বার হতে শুরু করে দিল। ডাক্তার বললেন, ঘরের তাপমাত্রা খুব বেশি করে রাখার ফলেই এই কাণ্ড। কয়েক দিন পরে জলের পাইপ ফেটে আর এক বিপদ। এক বন্ধু উপদেশ দিল, সব সময়ে অল্প করে কল খুলে রাখতে হবে, যাতে পাইপে বরফ জমলেও ফেটে না যায়। ছোট হিটার কী করে ব্যবহার করতে হয়, তা-ও শিখতে হয়েছে। এখানে বাড়ি কাঠের তৈরি। হিটার থেকে নানা ভাবে আগুন ধরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঠিক মতো হিটার চালাতে না-পারলে তাই সমূহ বিপদ। দরজা-জানলা বন্ধ করার মতো সাধারণ কাজটুকুও তখন দুঃসাধ্য মনে হত। যতই জানলা বন্ধ করি না কেন, জানলার তলা দিয়ে হাড়হিম হাওয়া ঢোকে। হাওয়া ঢোকা বন্ধ করতে কী করে জানলা ‘সিল’ করা যায়, তা-ও মাথা খাটিয়ে বার করতে হয়েছে। সব থেকে অসুবিধে হত সেন্টিগ্রেড আর ফ্যারেনহাইটের ফারাক বুঝতে। চিরকাল জেনে এসেছি, শূন্য ডিগ্রিতে জল জমে বরফ হয়ে যায়। সেটা সেন্টিগ্রেডের মাপ। এখানে ব্যবহৃত হয় ফ্যারেনহাইট, যে মাপকাঠিতে জল জমে যায় ৩২ ডিগ্রিতেই!

দু’দশক পার করে দিলাম। মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড শুনে এখন আর আঁতকে উঠি না। নিত্য-নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার আমাদের কাজটাকে আরও সহজ করে দিয়েছে। এখন আর ভেবে-চিন্তে থার্মোস্ট্যাটের তাপমাত্রা ঠিক করতে হয় না। বুদ্ধিমান, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি নিজে থেকেই বুঝে যায়, কী রকম তাপমাত্রা উপযোগী ও আরামদায়ক। বরফের উপর দিয়ে চলার সময়ে যাতে দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, তার জন্য গাড়িতে লাগানো থাকে নিত্যনতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখানে যতই ঠান্ডা পড়ুক না কেন, বাড়ি-গাড়ি-অফিস সব জায়গাতেই নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা বজায় রাখা হয়। কিন্তু কোনও কারণে রাস্তায় বার হতে হলেই মুশকিল। তখন ভারী জ্যাকেট না পরলে রেহাই নেই। তাই শীতকালে পরতে পরতে জামাকাপড় পরি। ঘরের ভিতরে থাকলে উপরের পরতগুলো খোলসের মতো খুলে রাখি। ছেলেদের স্কুলেও পাঠাই সে ভাবে। কারণ প্রচণ্ড বরফ না পড়লে খুব ঠান্ডাতেও ছেলেমেয়েরা বাইরের মাঠে খেলাধুলো করে।

মেরু ঘূর্ণাবর্ত (পোলার ভর্টেক্স) কী

দুই মেরুকে ঘিরে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিম্নচাপ এবং ঠান্ডা হাওয়া। গ্রীষ্মে দুর্বল এবং শীতে শক্তিশালী। ভর্টেক্স-এর অর্থ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে বায়ুপ্রবাহ যা মরু অঞ্চলে ঠান্ডা হাওয়া চলাচল বজায় রাখতে সাহায্য করে। উত্তর গোলার্ধে আবার শীতের সময় মেরু আর্বত আরও প্রসারিত হয়, দক্ষিণের দিকে দ্রুত গতিতে ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত পাঠায়। শীতে এমনটা প্রায় রোজ হতে থাকলে আমেরিকায় মেরু বাতাসের প্রকোপ বাড়ে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এমনটা ঘটেছিল। তার আগে ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৯-এও এমন হিমশীতল সময়ের সাক্ষী হয়েছে আমেরিকা।

এ বার শীত শুরু হয়েছিল হাল্কা চালেই। তারপরেই খবর এল, মেরু-ঘূর্ণাবর্ত আসছে! বুঝলাম, এ বছরও নিষ্কৃতি নেই। আমার এগারো বছরের দুই যমজ ছেলে স্মার্ট স্পিকার অ্যালেক্সাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিল, শিকাগোয় নাকি এখন মেরু অঞ্চল বা মাউন্ট এভারেস্টের থেকেও বেশি ঠান্ডা। সেখানে নদী জমে বরফ হয়ে গিয়েছে, রেল লাইনে আগুন জ্বালানো হচ্ছে যাতে বরফে ট্রেন লাইনচ্যুত না হয়ে যায়। ভাগ্যিস শিকাগোয় থাকি না!

নিউ ইয়র্ক-নিউ জার্সি কখনও থমকে দাঁড়ায় না। তা সে যতই উত্তর মেরু থেকে হিম-হাওয়া ধেয়ে আসুক না কেন। দেখছি, বরফ ঝড়ের মধ্যেই রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বসেছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। ঘরছাড়ারা জড়ো হয়েছেন সাবওয়ে স্টেশনে। যত ক্ষণ কয়েক ফুট বরফ না-জমে যান চলাচল থমকে যাচ্ছে, স্কুল-কলেজ-অফিস, সব কিছুই চলছে নিজের ছন্দে।

এ দেশে ঠান্ডা আগেও পড়ত। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রকোপে এখন এক সপ্তাহের মধ্যে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি হয়ে যায়। আমাদের প্রেসিডেন্ট তা শুনছেন কই? তিনি তো টুইট-রসিকতাই মজে। মেরু-ঘূর্ণাবর্তের কোনও ঝাপটা হোয়াইট হাউসে পৌঁছয় বলে তো মনে হয় না!

লেখক ইঞ্জিনিয়ার, বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত

USA Winter Polar Vortex
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy