জন্মভূমি ভারতে ভোটের উৎসব আসে মাঝেমধ্যেই। ছবি: এএফপি।
ভোটের বাজার খুব জমজমাট। জন্মভূমি ভারতে ভোটের উৎসব আসে মাঝেমধ্যেই। কোনওটা শহুরে, কোনওটা গ্রাম্য, কোনওটা আবার দেশীয়। এর মধ্যে লোকসভা ভোট আড়ে-বহরে সবচেয়ে উঁচু দরের। এ বার আসন্ন সেই ভোট। খবরের কাগজে, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিসংখ্যানের হিসেবে-নিকেশ চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছোটবড় নেতা, তাত্ত্বিক নেতাদের গলাবাজিও চলছে। বর্তমান সরকারের কাজকর্মের হিসেবে-নিকেশ বোদ্ধাদের মুখে। কেউ কেউ কাজের ফিরিস্তি দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন সরকার নাকি জনবিরোধী, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। ছোটবেলায় মনে আছে, তখন বামপন্থীরা কেন্দ্রে ইন্দিরা গাঁধী আর রাজ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকারকে লড়াই দিতে রাস্তায় রাস্তায় গ্রামেগঞ্জে এককাট্টা হচ্ছেন। খুদে আমি, দোতালার বারান্দা থেকে দেখলাম নীচে গলি দিয়ে লাল পতাকা নিয়ে মিছিল যাচ্ছে। ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’ স্লোগান। সে মিছিলে পাড়ার রকের বাপিদা-টুবাইদা হেঁটেছিল, এটাও খুব মনে আছে। অথবা ‘ভোট দিন বাঁচতে, তারা হাতুড়ি কাস্তে’। সে বার দ্বিধা-বিভক্ত বামপন্থীদের সিপিআই কংগ্রেসের সাথে জোট বেঁধেছিল। তাতে সিপিএম স্লোগান লিখল ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই’। প্রসঙ্গত, তখন কংগ্রেসের চিহ্ন ছিল গাইবাছুর। পাড়ায় ছোট নেতারা ছোট সভা করতেন। ময়দানে মাঝারি থেকে বড়মাপের নেতাদের জনসভা হত।
আর একটু বড় হয়ে, কিশোর বয়সে, তখন-ও ভোট দেওয়ার অধিকার হয়নি, ভোটের দিনগুলো বেশ একটা উৎসবের উত্তেজনা হত। আমার বাবা চিরকাল ভোটের ডিউটিতে যেতেন। এক বার-ও কাটিয়ে যেতে দেখিনি। মা সে জন্য ভোটের দিন উৎকণ্ঠায় কাটাতেন। কিন্তু আমার অতশত চিন্তা করার মন ছিল না। আমি বাড়ির কাছের বুথের সামনে পার্টির তাঁবুতে গিয়ে লেমনেড খেতাম। ভোটের আগের প্রচারের দিনগুলো, পাড়াতুতো দাদা-মামা-কাকাদের দেওয়াল লেখা দেখতে বেশ লাগত। সারা বছর প্রায় রকবাজ নিষ্কর্মা ছেলেগুলো বেমক্কা দিনরাত জেগে দেওয়াল লিখত। পার্টি অফিসে ডাঁই করে রাখা থাকত পোস্টার-ফেস্টুন, গঁদের আঠার বিটকেল গন্ধে ম-ম করত রং ওঠা পার্টি অফিসের দেওয়াল। বড় হয়ে যখন ভোট দেওয়ার মতো বয়স হল, তখন থেকে যত দিন দেশে ছিলাম, আমার ভোট দেওয়ার সুযোগই হয়নি। সেটা অবশ্যই ইচ্ছাকৃত নয়। কলেজ জীবনের পর থেকেই আমি শহর ছাড়া। আর কোনও এক জায়গায় থিতু হইনি বলে ভোটার তালিকায় নাম হাজির করার সুযোগ হয়নি। তবে যেখানেই থাকি না কেন, ভোটের আঁচ অনুভব করেছি বরাবর। শহর জুড়ে নেতা-নেত্রীদের ফ্লেক্সের বিশাল কাট আউট।
রাস্তা জুড়ে মাথার ওপরে চ্যানেল ফেস্টুন। ভোটের প্রচারে লরির মাথায় চ্যালা চামুন্ডা-সহ, সারা বছর গায়েব থাকা, দন্তবিকশিত ভোটপ্রার্থী। নির্বাচন কমিশনের ভোটার লিস্ট কাটা-ছেঁড়া যোগবিয়োগের পর্বতপ্রমাণ কাজের বোঝা। তাই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আকচা-আকচি, কিচির মিচির।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
প্রায় কুড়ি বছর হল আমি দেশছাড়া। এর মধ্যে কানাডাতেই পনেরো বছর হয়ে গেল। কানাডায় নাগরিকত্বের সঙ্গে ভোটাধিকারও পেয়েছি। এখানে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে ফেলতে হয় না। নাগরিক হলে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই ভোটার তালিকায় নাম এসে যায়। আবার নাবালক থেকে সাবালক হলেও তাই। যেমন আমার কন্যার ভোটার লিস্টে নাম উঠেছে আমাদের অজান্তেই। ঠিকানা পরিবর্তন হলে ভোটার কেন্দ্র নিজের থেকেই বদলে যায়। তার জন্যও কোনও আলাদা তদ্বির করতে হয় না।
এখানে ফেডারেল ইলেকশন, যা আমাদের লোকসভা ভোটের সমান, হয় চার বছর অন্তর। প্রভিনশিয়াল, যাকে আমরা বলি বিধানসভা, সে-ও হয় চার বছরে এক বার। রাজনৈতিক দল হাতে গোনা। তাদের মধ্যে তিনটে প্রধান দল— কনজ়ারভেটিভ, লিবারাল আর ডেমোক্রেটিক।
এখানে দেখেছি, রাজনীতিতে আসতে গেলে বা নেতা হতে গেলে, তরুণ বয়স থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। যেমন স্কুল কাউন্সিল, কলেজ কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল ইত্যাদিতে যোগ দেওয়া বা সেখানকার ভোটে জেতাটা খুব জরুরি। রাজনীতি করলে কেউ ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াচ্ছে বলে মনে করা হয় না। বরং অল্পবয়সি বাগ্মী ছাত্রনেতাদের মানুষ ভাল-ও বাসে এবং যথেষ্ট সম্মান আর গুরুত্ব দেয়।
এখানে ভোটের সময়ে প্রচার নিয়ে হইহই রইরই, মারমার কাটকাট নেই। প্রচার মূলত হয় জনসংযোগের মাধ্যমে— ই-মেলে বা সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছোট ছোট অনুষ্ঠানেও হাজির থাকেন প্রার্থী। যেমন চার বছর আগের আমাদের দুর্গাপুজোর সময়ে ফেডারেল ইলেকশন ছিল। শহরের দু’জন লিবারাল পার্টির প্রার্থী পুজোয় অংশগ্রহণ করেছিল। রাজনীতির কথা কিছু বলেননি। খালি অনেকের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলেন একান্তে। পোস্টারমুখী প্রচার বলতে রাস্তার ধারে ছোটছোট প্ল্যাকার্ড লাগাতে দেখেছি, তা-ও তার উচ্চতা দু’ফুটের বেশি না।
আমি গিয়েছিলাম ভোট দিতে। ফেডারেল ইলেকশনে, আবার প্রভিনশিয়াল ইলেকশনেও। বাড়ির কাছের প্রাইমারি স্কুলে। এখানে অবশ্য কোনও পার্টির তাঁবু বা বুথের সামনে হইচই নেই। কোনও আধাসেনা নেই। এমনকি পুলিশও নেই কোথায়।
খালি কয়েক জন বয়স্ক মানুষ, তাঁরাই নাকি ভলান্টিয়ার! কার কোন ঘরে গিয়ে ভোট দিতে হবে দেখিয়ে দিচ্ছেন। ভোটার তালিকা মিলিয়ে ভোট দিলাম। ব্যালট পেপারে দলের নাম আর প্রার্থীর নাম লেখা আছে, পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে দিতে হবে। রবার স্ট্যাম্প তো নেই-ই। বোতাম-টেপা ভোটযন্ত্র দুর অস্ত্। ভোটের কালি দিয়ে কেউ আঙুল দাগিয়েও দিলেন না। দেশের তুলনায় এ রকম নিস্তেজ ভোট দেখে মনটা বেশ দমে গেছিল। কিন্তু পরে শুনলাম সারা কানাডায় ভোট দিয়েছে ৭০ শতাংশ মানুষ। এ দেশে তা হলে রাজনীতি সচেতনতা কম নয়!
লেখক তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy