উতপ্ত নিয়ন্ত্রণ রেখা। হামলা, পাল্টা-হামলা চলছে। দু’পক্ষের প্রাণহানির তালিকা দ্রুত বাড়ছে। মঙ্গলবার পাক হামলায় প্রাণ যায় তিন ভারতীয় জওয়ানের। এর মধ্যে এক জনের দেহকে বিকৃত করেছে পাক সেনা। জবাবে বুধবার থেকে প্রবল প্রত্যাঘাত শুরু করেছে ভারতীয় সেনা। আর এই আবহাওয়ার মধ্যেই পাল্টে যাচ্ছে পাক সেনাপ্রধান। ২৯ নভেম্বর নিজের পদ থেকে অবসর নিচ্ছেন পাক সেনা প্রধান রাহিল শরিফ। দু’দশকের মধ্যে এই প্রথম অবসরের সময়সীমা না বাড়িয়ে অবসর নিচ্ছেন কোনও পাক সেনাপ্রধান। কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন সেনাপ্রধানের ঘোষণা করবেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়ার শরিফ। পাক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শরিফ এ নিয়ে ষষ্ঠ বার নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ করবেন। পাক সেনা ও পাক সরকারের মধ্যে এ নিয়ে তলে তলে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। কে বসবে পদে তা নিয়ে শুরু হয়েছে উৎকণ্ঠা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রেখে চলেছে।
তবে শুধু ভারতই নয়, পরবর্তী সেনাপ্রধানের সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের সামনে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বেশ খারাপ। সেটাকে উদ্ধার করা। চিনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর সবচেয়ে বেশ জরুরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করা। ট্রাম্প যদি তাঁর ঘোষিত নীতিই মেনে চলেন তবে পাকিস্তান তথা পাক সেনার সমূহ সমস্যা। সেই সমস্যাকে ঠিক মতো সামলানোর দায়িত্বও থাকবে নতুন সেনাপ্রধানের সামনে। এর বেশ কিছু কাজ নিজের সময়ে সফল ভাবে করেছিলেন রাহিল শরিফ।
বিদায়ী পাক সেনা প্রধান রাহিল শরিফ।
২০১৩-এর নভেম্বরে জেনারেল আসফাক পারভেজ কিয়ানির থেকে দায়িত্ব নেন রাহিল শরিফ। পরিস্থিতি ছিল সঙ্কটময়। পাক সেনার অন্যতম ভরসা আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। অ্যাবটাবাদে পাকিস্তানের সেনা অ্যাকাডেমির নাকের ডগায় ওসামা বিন লাদেনের আস্তানায় ঢুকে তাকে হত্যা করে মার্কিন সেনা। পাক-আফগান সীমানায় তালিবান দৌরাত্ম দমনে পাক সেনার অনীহা আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলেছিল। মার্কিন নীতি প্রকাশ্যে ভারতের দিকে হেলেও পড়েছিল ।
দু’জন সেনা কর্তাকে টপকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন রাহিল। সেনা পরিবারেই তাঁর জন্ম। দাদা রানা সাবির শরিফ ১৯৭১-এর যুদ্ধে মারা যান। তাঁর ‘বীরত্বের স্বীকৃতি’ হিসেবে সাবিরকে সর্বোচ্চ সম্মান নিশান-ই-হায়দার দেয় পাক সেনা। ভাই রাহিলের কেরিয়ার গ্রাফটিও ঈর্ষণীয়। পাক সেনার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে কাজ করার পরে সেনা প্রধানের দায়িত্ব আসে রাহিলের হাতে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জুবাইর মাহমুদ হায়াত।
রাহিল দায়িত্ব নেওয়ার পরে এক দিকে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি, অন্য দিকে চিনের সঙ্গে আরও নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলতে শুরু করেন। আমেরিকার দাবি মেনে সোয়াত উপত্যকায় তালিবান বিরোধী অভিযান ‘জারব-ই-আজব’ শুরু করেন। ওই অঞ্চলে পাক তালিবানদের একচ্ছত্র আধিপত্য তাতে কিছুটা হলেও ধাক্কা খায়।
ঠিক এক বছরের মাথায় পেশোয়ার স্কুলে হামলা রাহিলের হাত আরও শক্ত করে। মিলিটারি কোর্টে বিচার শুরু হয়। মৃত্যুদণ্ডের উপরে স্থগিতাদেশ তুলে নেন রাহিল। এতে সন্ত্রাসের অপরাধীদের পর পর ফাঁসি শুরু হয়। একই সঙ্গে করাচিতে প্রতিনিয়ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সংঘাত থামাতে আলাদা আধাসামরিক বাহিনী তৈরি করেন রাহিল। এতে ওই অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। পাক রাজনীতিতে মাথা গলালনি রাহিল। সব মিলিয়ে পাক সমাজে রাহিল বেশ জনপ্রিয়। তাই অবসরের সময়সীমা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রকাশ্য আসার পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়ে যায়। পরোক্ষে যা নওয়াজের উপরেই চাপ বাড়াচ্ছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইসফাক নাদিম আহমেদ।
কাকে বাছবেন নওয়াজ। চারটি নাম ঘোরাঘুরি করছে। বয়সের দিক থেকে এগিয়ে আছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জুবাইর মাহমুদ হায়াত। তিনি এখন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। এর পরেই আছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইসফাক নাদিম আহমেদ। ইসফাক বর্তমানে মুলতান কর্পসের কমান্ডার। একই সঙ্গে আরও দু’টি নামও ভাসছে। ভাওয়ালপুর কর্পসের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জাভেদ ইকবাল রামদাই। আর লেফটেন্যান্ট কোমার জাভেদ বাজওয়া। যিনি এখন ইনস্পেক্টর জেনারেল ট্রেনিং অ্যান্ড ইভলিউশন।
সেনার মধ্যে গুজব, এর মধ্যে দু’টি নাম সম্পর্কে নিজের মত নওয়াজকে জানিয়েছেন রাহিল। রাহিল না কি জুবাইর মাহমুদ হায়াতকে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান করার পরামর্শ দিয়েছেন। সামরিক বাহিনী, বায়ুসেনা ও নৌবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে এই কমিটি তৈরি হয়। যুদ্ধের সময়ে তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করা এই কমিটির কাজ। জুবাইর মাহমুদ হায়াত এর আগে ডিরেক্টর জেনারেল অব স্ট্র্যাটিজিক প্ল্যান ডিভিশনের প্রধান ছিলেন। এই অংশটি পারমাণবিক অস্ত্রের দায়িত্ব থাকে। ফলে কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হায়াত তীব্র সঙ্কটের সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কিন্তু প্রায় দু’দশক ধরে এই কমিটির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন সেনা কর্তারা। নওয়াজের ইচ্ছে এ বার বায়ুসেনা বা নৌবাহিনীর প্রধান এই পদটি পান। তা ছাড়া শুধু সেনার হাতে না থেকে পদটি তিন বাহিনীর মধ্যে ঘুরতে থাকুক। কিন্তু এতে সেনার গোঁসা হয়েছে।
ভাওয়ালপুর কর্পসের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জাভেদ ইকবাল রামদাই।
আর সেনাপ্রধান হিসেবে রাহিলের পছন্দের ইসফাক নাদিম আহমেদ। নাদিম এর আগে চিফ অব জেনারেল স্টাফ এবং ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন (ডিজিএমও) হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে ভারতের সঙ্গে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা নাদিমের বেশি। সম্প্রতি খাইরপুর টামেওয়ালিতে এক সামরিক মহড়ার আয়োজন করে পাক সেনা। সেই মহড়ার মূল দায়িত্বে ছিলেন নাদিম। হাজির ছিলেন নওয়াজ। রাহিল শরিফ নাদিমকে তুলে ধরতেই এই ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল নাদিম বেশ স্পষ্টবাদী। মুখের উপরে কথা বলেন। তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া নওয়াজ সরকারের পক্ষে কঠিন হতে পারে।
এই সূত্রে জেনারেল বাজওয়ার নাম সামনে আসছে। বাজওয়া দীর্ঘ দিন কাশ্মীরে দায়িত্বে ছিলেন। এখন পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে কাশ্মীর সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোক নওয়াজের দরকার পড়তে পারে। তবে কারও কারও মতে মাঝখান থেকে এই দৌড়ে ডার্ক হর্স হতে পারেন জাভেদ ইকবাল রামদাই।
লেফটেন্যান্ট কোমার জাভেদ বাজওয়া।
পাঠানকোট হামলা, উড়িতে হামলার পরে বিশ্বে পাকিস্তান কোণঠাসা। এ নিয়ে পাক সেনার সঙ্গে নওয়াজ সরকারের তীব্র মতভেদ রয়েছে। মুম্বই হামলার অভিযুক্ত জাকিউর রহমান লকভি, মাসুদ আজহারের মতো ব্যক্তিকে দমন করতে আগ্রহী পাক সরকার। কিন্তু এ পথে বড় বাধা পাক সেনা। ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর বর্তমান প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রিজাউন আখতারের জায়গায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল সারফারাজ সাত্তারকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
সব মিলিয়ে সামনের কয়েকটি দিন পাক সরকার ও পাক সেনার উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকবে। ১৯৯৯-এ পারভেজ মুশারফকে সেনাপ্রধান করেছিলেন নওয়াজ। তার পরে মুশারফের হাতেই ক্ষমতা হারিয়েছিলেন নওয়াজ। তার পরে বাকিটুকু ইতিহাস। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। ফলে সামনের সেনাপ্রধানকে বাছতে নওয়াজ যে বেশ চিন্তাভাবনা করবেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আরও পড়ুন: ট্রাম্প প্রথম নন, হোয়াইট হাউসের বহু বাসিন্দার গায়েই কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কালো দাগ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy