Advertisement
২৬ মে ২০২৪

স্বজনহারা উপত্যকায় নতুন সসপ্যানে চায়ের জল

সে দিনের কথা বলতে গিয়ে এখনও শিউরে ওঠেন ৩৭ বছরের শিরিং দর্জি লামা। ২০১৫-র ২৫ এপ্রিল। বেলা বারোটা নাগাদ কেঁপে উঠেছিল পায়ের তলার বিস্তীর্ণ সবুজ।

ধ্বংসের মধ্যে বসেই জপ যন্ত্র ঘোরাচ্ছেন বৃদ্ধ। (ডান দিকে) নিজের নতুন হোটেলে চায়ের জল চাপিয়েছেন নেপালি তরুণী।— নিজস্ব চিত্র

ধ্বংসের মধ্যে বসেই জপ যন্ত্র ঘোরাচ্ছেন বৃদ্ধ। (ডান দিকে) নিজের নতুন হোটেলে চায়ের জল চাপিয়েছেন নেপালি তরুণী।— নিজস্ব চিত্র

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৫০
Share: Save:

সে দিনের কথা বলতে গিয়ে এখনও শিউরে ওঠেন ৩৭ বছরের শিরিং দর্জি লামা।

২০১৫-র ২৫ এপ্রিল। বেলা বারোটা নাগাদ কেঁপে উঠেছিল পায়ের তলার বিস্তীর্ণ সবুজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দু’টি শৃঙ্গ লাংটাং রি আর লাংটাং লিরুং বেয়ে নেমে এসেছিল চাঁই চাঁই তুষারধস। ‘‘বরফ-মাটি-পাথর-কাদার বিশাল তালগুলো আইসক্রিমের স্কুপের মতো চেঁছে নিয়ে চলে গেল আমাদের এতগুলো ঘরবাড়ি।’’ পালাতে গিয়ে গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল কাঠের বাড়ি। শরীরের বারোটা হাড় ভেঙেছিল, গোটা কুড়ি সেলাই পড়েছিল। কাঠমাণ্ডুর হাসপাতালের বিছানায় চোখ মেলেছিলেন দিন সাতেক পর। ‘‘চোখ না-মেললেই বোধহয় ভাল হতো। বাবা-মা-স্ত্রী-ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেতে হতো না একসঙ্গে।’’ গলা বুজে আসে শিরিংয়ের।

নেপালের রসুয়া জেলার ল্যাংট্যাং উপত্যকা। কান পাতলে শিরিংয়ের মতো হাহাকার ঘরে ঘরে। তবু তারই সঙ্গে দাঁতে দাঁত চাপা জেদ। ঘুরে দাঁড়ানোর, পর্যটকদের আবার ডেকে নেওয়ার জেদ। শিরিংরা বললেন, ‘‘এই বছর থেকেই জিনিসপত্র আনতে শুরু করেছি। একটা কাঠামো দাঁড়ও করিয়েছি। এখন অপেক্ষা পর্যটকের। নইলে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব।’’

ভূমিকম্পের আগে শীত ও বর্ষা বাদ দিয়ে বছরের বাকি সময়টায় অন্তত হাজার পাঁচেক পর্যটক এই পথে আসতেন। এ বছর মার্চ-এপ্রিল থেকে সংখ্যাটা শখানেকের বেশি যায়নি। এই ট্রেক রুটে ১৫ বছরেরও বেশি গাইডের কাজ করছেন শ্যাম তামাঙ্গ। জানালেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন এজেন্সির তরফে বেশি করে বিজ্ঞাপন করছি লাংট্যাং ট্রেকের। নেপালের অন্য কোনও ট্রেকিং রুট এ ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি ভূমিকম্পে।’’

নেপাল সরকার ও কিছু বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে এখনও নিয়মিত কিছু ত্রাণ আসে উপত্যকায়। খাবার, জামা-কাপড়, টাকা পয়সা। কিন্তু তাতে ফুরোয় না সমস্যা। নতুন বাড়ি বানানোর জন্য প্রতিটা কাঠের টুকরো, টিনের চাল, চেয়ার, টেবিল, বাসন, জ্বালানি এমনকী রোজকারের খাবারটুকুও সমতল থেকে নিয়ে আসতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। কাঠমান্ডু থেকে বাসে বা গাড়িতে ঘণ্টা সাত-আট চলার পরে পৌঁছনো যায় রসুয়া জেলার স্যাফ্রু বসি গ্রামে। এর পর হাঁটা পথ। ছোট ছোট জনপদ পেরিয়ে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ উজিয়ে ল্যাং ট্যাং।

কথা হচ্ছিল শিরিং দোলমা লামার সঙ্গে। ১৮ বছরের ফুটফুটে তরুণী। গত বছর এপ্রিলে পরীক্ষার জন্য কাঠমান্ডুতে ছিলেন। বাবা, মা, দিদি, কাকু, কাকিমা, মাসি, পিসি— পরিবারের একটা মানুষও বেঁচে নেই আর। ‘‘দিন সাতেক পর পৌঁছতে পেরেছিলাম। কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাইনি। কাউকে খুঁজে পাইনি।’’ পরিবারের সকলের দেহ উদ্ধার হয়েছিল পরে। মুখে ম্লান দোলমা বললেন, ‘‘আমি একটুও কাঁদতে পারিনি। শুধু ভেবেছি, ফিরতেই হবে আমায়।’’

ফিরেছেন দোলমা। ফিরিয়েছেন জীবনও। নিজের চেষ্টায় আর সরকারি সহায়তায় নতুন করে তৈরি করে ফেলেছেন ছোট্ট একটি হোটেল। নতুন হোটেলের নতুন চুলোয় নতুন সসপ্যানে চায়ের জল চাপান তিনি। দু’জন ফরাসি ট্রেকার এসেছেন যে তাঁর ঠিকানায়।

চারশোরও বেশি মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা লাংট্যাং গ্রামে ভূমিকম্পের আগে প্রায় ৪০-৫০টি হোটেল ছিল। পাঁচশো পর্যটককে একসঙ্গে থাকতে দেওয়ার সংস্থান ছিল। দূর থেকে চোখে পড়ত, ঢালাও সবুজের বুকে ঘন হয়ে চিক চিক করছে ছোট ছোট গেস্ট হাউস, হোম-স্টে, হোটেল, ধোঁয়া ওঠা রান্নাঘর। উপত্যকার ইতিহাস বলে, ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে যখন নির্বাসিত হয়েছিলেন দলাই লামা, এই উপত্যকা পেরিয়েই ভারতে এসেছিলেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন কয়েক হাজার অনুগামী। লাংট্যাং নদীর ধারে বিছিয়ে থাকা সবুজ গ্রামটায় অনেকেই বসবাস শুরু করেন। আস্তে আস্তে ট্রেকিং-এর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে। তবে বাসিন্দাদের অনেকেরই এখনও নেপালের নাগরিকত্ব নেই। সরকারি ভাবে তিব্বতের মানুষও নন।

এমনই এক মানুষ দাওয়া লামা। বয়স সত্তর। লোলচর্মে প্রায় বুজে গিয়েছে খুদে চোখ। তিব্বতি ভাষায় জানালেন, বাবার সঙ্গে এ-পারে এসেছিলেন ১৩ বছর বয়সে। এখন তিন কুলে কেউ নেই। গত বছরের অভিশপ্ত দিনটায় নদীর ধারে কয়েকটা কাপড়জামা নিয়ে গিয়েছিলেন কাচবেন বলে। তালগোল পাকিয়ে নদীতে পড়ে যান। কোনও রকমে একটা পাথর আঁকড়ে বেঁচে যান। গ্রামের বৃদ্ধতম মানুষটিকে নতুন ঘর বেঁধে দিয়েছেন গ্রামবাসীরাই। মেঘলা বিকেলে ধ্বংসস্তূপের দিকে চেয়ে এক মনে ধর্মচক্র ঘুরিয়ে চলেন তিনি। কান্না আর প্রার্থনা মেখে ভেসে বেড়ায় ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের পালক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nepal Disaster
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE