প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সপরিবার ইনায়ৎ রাশিয়া থেকে চলে গিয়েছিলেন লন্ডন। সেখানেই নটিং হিল-এ স্কুলে ভর্তি হন নূর। ১৯২০ সালে এই পরিবারের নতুন ঠিকানা হয় প্যারিস। তার ৭ বছর পরে ভারত সফরের সময় মৃত্যু হয় ইনায়ৎ খানের। অকালে বাবার মৃত্যুর পরে শোকস্তব্ধ মা এবং তিন ভাইবোনের দায়িত্ব অনেকটাই এসে পড়ে ত্রয়োদশী নূরের উপর।
শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়ার পরে ছোটদের জন্য গল্প ও কবিতা লিখতে শুরু করেন নূর। ছোটদের পত্রিকা এবং ফরাসি রেডিয়ো চ্যানেলে তিনি ছিলেন পরিচিত নাম। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘টোয়েন্টি জাতকা টেলস’। বৌদ্ধধর্মের জাতককাহিনী অনুসরণে লেখা বইটি প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনেই। পাশাপাশি, তিনি পিয়োনা ও হার্পবাদনেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দখলে চলে যায় ফ্রান্স। পুরনো ঠিকানা ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে পালাতে বাধ্য হন আমিনা। ফরাসি বন্দর বোর্দো থেকে প্রথমে তাঁরা পৌঁছন ইংল্যান্ডের কর্নওয়াল, তার পর সেখান থেকে সাদাম্পটনে। প্রাথমিকভাবে তাঁদের ঠাঁই হয় দার্শনিক বাসিল মিশেলের বাড়িতে। বাসিলের বাবা কোনও এক সময়ে ছিলেন নূরের বাবার শিষ্য।
ফরাসি ভাষায় তুখোড় এবং ব্যক্তিত্বে সপ্রতিভ নূরকে পাঠানো হয় নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সে। রেডিয়ো অপারেটর হিসেবে কাজ করার জন্য। তিনি প্রথম মহিলা রেডিয়ো অপারেটর যাঁকে আন্ডাকভার এজেন্ট হিসেবে ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল। প্রথমে মনে করা হয়েছিল তিনি দেড় মাসের বেশি কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে তিনি ৩ মাস কাজ করেছিলেন। অক্ষশক্তির অবস্থান, পরবর্তী পদক্ষেপ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি ফ্রান্স থেকে ব্রিটেনে পাঠাতে পেরেছিলেন।
তবে প্রশিক্ষণপর্বে যে সব বিভাগেই নূর উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তা নয়। বরং, তাঁর বিরুদ্ধে বহু ক্ষেত্রেই দক্ষতার অভাবের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু রেডিয়ো অপারেটর হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং ফরাসি ভাষার উপর দখল দেখে তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়। নূরের ভাই বিলায়ৎও যুদ্ধে যোগদানের ক্ষেত্রে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু গাঁধীবাদের ভক্ত দুই ভাইবোনই সরসারি মানুষকে হত্যা করার বিরোধী ছিলেন। তাই নূর গুপ্তচরের কাজ বেছে নেন, যেখানে মানুষকে সরাসরি হত্যা করতে হবে না। কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছেপূরণ হবে।
নূরের ভাই পরে সুফিসঙ্গীত সাধনাতেই নিজের জীবন কাটিয়েছিলেন। তবে জীবনভর তাঁর আক্ষেপ ছিল, কেন তিনি দিদিকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। পরিবারকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নূরের কাছে সবথেকে কঠিন কাজ ছিল তাঁর মাকে জানানো। মাকে তিনি বলেছিলেন, তিনি আফ্রিকা যাচ্ছেন। পাশাপাশি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন তাঁর অবস্থান ও কাজ যেন মাকে কোনওভাবেই জানানো না হয়। একমাত্র তাঁর মৃত্যুর পরই মাকে খবর দেওয়া হয়।
ফ্রান্সে থাকার সময় তিনি বাচ্চাদের নার্সের ছদ্মপরিচয় নিয়েছিলেন। তাঁর ছদ্মনাম হয়েছিল ‘জেন মারি রেইনিয়ের’। তাঁর পা রাখার দিন দশেকের মধ্যে ফ্রান্সে কর্মরত ব্রিটেনের সব গুপ্তচর ধরা পড়ে যায়। শত্রুপক্ষের মধ্যে তিনি অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত জেনেও নূর ফ্রান্স ছেড়ে ব্রিটেনে পালাতে চাননি। অন্য গুপ্তচর বা স্পেশাল অপারেশনস এগজিকিউটিভদের কাছে তাঁর নাম ছিল ‘মাদেলেইন’।
এজেন্ট অঁরি-র সাঙ্কেতিক নাম ছিল গিলবার্ট। ফরাসি বিমানবাহিনীর প্রাক্তন এই পাইলট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। অর্থাৎ অক্ষ এবং মিত্রশক্তি, দুই তরফেই তিনি ছিলেন গুপ্তচর। অন্যদিকে রেনে ছিলেন এমিল অঁরি গ্যারির বোন। কাজের সূত্রে নূর এবং এমিল পরিচিত ছিলেন। পরে এমিলকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে নূরকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন রেনে। আর এক এসওই এজেন্ট ফ্রাঁ অঁতেলমে-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। কিন্তু নূরের কাজে ফ্রাঁ-এর মুগ্ধতা মেনে নিতে পারতেন না রেনে। অভিযোগ, ১ লক্ষ ফ্রাঁ বা কোনও সূত্র অনুযায়ী ৫০০ পাউন্ড অর্থের বিনিময়ে তিনি নূরের গোপনীয়তা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে পরে রেনেও বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু দোষী প্রমাণিত হননি।
বিশ্বাসঘাতকতার শিকার নূর ধরা পড়ে যান ১৯৪৩ সালের ১৩ অক্টোবর। নাৎসিদের গোয়েন্দা বিভাগ বা এসডি বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হয় তাঁকে। তৎকালীন এসডি প্রধান কিয়েফের পরে স্বীকার করেছিলেন জেরায় নূরের মুখ থেকে তাঁর কাজ সংক্রান্ত কোনও কথা বলানো যায়নি। তিনি ক্রমাগত নিজের শৈশবের গল্প করে গিয়েছিলেন। বিভ্রান্ত করেছিলেন নাৎসি গোয়েন্দাদের।
পরবর্তী সময়ে নূরের জীবনীকার আর্থার ম্যাগিডা সংবাদমাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান। নূরকে গ্রেফতার করার পরে গেস্টাপো বাহিনী নিশ্চিত হতে চেয়েছিল তাঁর পরিচয় নিয়ে। নূরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিলাসবহুল শৌখিন দোকানে। বলা হয়েছিল, পছন্দসই জিনিস কিনতে। এখানে কিন্তু গেস্টাপোর ধূর্ত চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি নূর। তিনি যা যা পছন্দ করেছিলেন, সব ছিল নীল রঙের। এ বার নাৎসিদের সন্দেহ নিরসন হয়। কারণ তাঁরা জানতেন, নূরের প্রিয় রং নীল। নীল রঙের প্রতি দুর্বলতা শেষ অবধি তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
বাইরে জগতের কাছে নূর, মাদেলেইন ছিলেন মায়ের আদরের নোরা। মেয়ের মৃত্যুর পরে পাঁচ বছর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে বেঁচে ছিলেন আমিনা বেগম। তাঁর বাকি তিন সন্তান অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। ৮৮ বছর বয়সে বিলায়ৎ প্রয়াত হন ২০০৪ সালে। হিদায়ৎ প্রয়াত হন ২০১৬ সালে, ৯৯ বছর হয়সে। আর এক মেয়ে খায়র উন নিসা প্রয়াত হন ৯১ বছর বয়সে, ২০১১ সালে।
গুপ্তচর হলেও নূরের জীবন অনুচ্চারিত থাকেনি। ১৯৪৯ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘জর্জ ক্রস’-এ সম্মানিত করা হয়। ফ্রান্সের তরফে ভূষিত করা হয় ‘ক্রোয়া দ্য গ্যের’ সম্মানে। ২০১২ সালে তাঁর আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয় লন্ডনে। ২০২০ সালের অগস্টে নূরকে সম্মানিত করা হয় ব্রিটেনের ‘ব্লু প্লেক’ সম্মানে। প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে তিনি এই সম্মান লাভ করেন।
কোন দেশকে মাতৃভূমি বলে মনে করবেন? জানতেন না নূর। তাঁর বাবার সুফিবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বমানবতাই ছিল তাঁর দেশ। ডাকাউ ক্যাম্পের এক ওলন্দাজ বন্দি পরে জানিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে নূরের শেষ উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘লিবার্তে’। কার মুক্তি চেয়েছিলেন শিকড়হীন রাজউত্তরসূরি? নিজের যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবন থেকে কি? উত্তর চলে গিয়েছে তাঁর সঙ্গেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy