আগেও বহু বার দুবাই গিয়েছি। এ বার সিট ছিল ইকনমির প্রথম ডান দিকে জানলার পাশে। উপর থেকে ছোট ছোট প্লেনগুলোও দেখতে পাচ্ছি। বুঝলাম এয়ারপোর্টের কাছে পৌঁছে গিয়েছি। হু হু করে প্লেন নামছে। সব কিছু নিয়মমাফিক, স্মুদ। ছোট্ট ঝাঁকুনিতে বুঝলাম প্লেন রানওয়ে টাচ করেছে। কিন্তু, তার পরেই গন্ডগোল। মনে হলো, প্লেনটা আবার উপর দিকে উঠে যেতে চাইছে। অবাক হলাম, কী হল রে বাবা!
সেকেন্ডের মধ্যে জানলা দিয়ে দেখলাম ডান দিকের ইঞ্জিনটা প্লেন থেকে আলাদা হয়ে সেই ইঞ্জিন ও প্লেনে আগুন ধরে গিয়েছে। গলার কাছটা শুকিয়ে এল! এক বার মনে হল, আর বোধ হয় ২-৩ মিনিট বাঁচব। সিটবেল্ট খুলে ফেলেছি। কিন্তু প্লেন তো হু হু করে রানওয়ে দিয়ে ছুটছে। মোবাইল এরোপ্লেন মোড-এ রাখা ছিল। ভাবলাম এখন তো সিগন্যাল পাব। স্ত্রী শীলাকে ফোন করে বলি, ‘ভালো থেকো, আমি চললাম।’ আবার মনে হলো, ও শুনে সামলাতে পারবে না।
এ ভাবে কত ক্ষণ কেটেছে, বলতে পারব না। মনে মনে যিশুকে ডাকছি। প্লেনের মধ্যে তখন চিৎকার। আচমকাই বিশাল ঝাঁকুনি! প্লেন দাঁড়িয়ে গেল। সামনের দেওয়ালটা ধরে ফেলেছিলাম। নয়তো বড়সড় আঘাত লাগত আমার। যাত্রীরা তখন ছোটাছুটি করছে। সামনে ককপিটের পাশে এমারজেন্সি দরজার দিকে এগোতেই ভকভক করে কালো ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করল প্লেনে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
সামনের দিক থেকে এক বিমানসেবিকা আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘পিছনের দিকে যান, এ দিকে আসবেন না।’ মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পিছনের এমারজেন্সির দরজা দিয়ে নামার জন্য হুড়োহুড়ি। আবার মনে হল, নাহ্! আজ প্রাণ নিয়ে প্লেন থেকে বেরোতে পারব না। আচমকা দেখি ডান দিকে এক বিমামসেবিকা একটা এমারজেন্সি দরজা সবে খুলেছেন। একেবারে আমার কাছেই। লাফিয়ে গিয়ে তাঁকে বললাম, ‘প্লিজ নামিয়ে দাও।’ বেলুনের মতো স্লিপ। সেখানে লাফিয়ে প্রায়
১৫ ফুট নীচে মাটিতে গিয়ে পড়লাম। উঠেই দৌড়।
জীবনে এমন দৌড়োইনি। ৫৮ বছর বয়স হয়েছে আমার। এই বয়সে প্রায় ৮ মিনিট একটানা দৌড়! পিছনে এক বার তাকিয়ে দেখেছি প্লেন তখনও দাউদাউ করে জ্বলছে। মনে হচ্ছিল আর পারব না। এ বার পড়ে যাব। ঠিক সেই সময়ে প্রকাণ্ড আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম প্লেনটা থেকে একটা আগুনের গোলা ছিটকে উঠে গেল আকাশে। আবার ছুট।
এক সময়ে মাটিতে বসে পড়লাম। আর এক পা চলার মতো শক্তি ছিল না। আমাদের একে একে উদ্ধার করে নিয়ে গেল এমিরেটসের কর্মীরা। বন্ধুরা এসেছিল রিসিভ করতে। এয়ারপোর্টে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের সঙ্গে হোটেলে এসে উঠেছি। হাত-ব্যাগ, স্যুটকেস কিছু সঙ্গে নেই।
বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে একা দুবাই আসা। বৃহস্পতিবারই রিসেপশন। উপহার কিনেছিলাম। তা-ও নেই কাছে। শুধু বুদ্ধি করে পাসপোর্ট আর টাকা পকেটে রেখেছিলাম! অনেক যাত্রীর পাসপোর্ট রয়ে গিয়েছে হাত-ব্যাগে। সে সব বোধ হয় পুড়ে খাক।
বৃহস্পতিবার সকালে তিরুঅনন্তপুরম থেকে ছেলে জীতেন চলে এসেছে দুবাই। মনে হচ্ছে, নতুন এক জন্ম পেলাম। বন্ধুর বিয়েতে এখন আমিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy