Advertisement
১১ মে ২০২৪

রকস্টার মোদী, এ বার ওয়েম্বলিতে

তখন ছিল নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার। আজ লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। নরেন্দ্র মোদী ফের রক-তারকার ভূমিকায়। মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ালেন বিদেশে তাঁর সব চেয়ে বড় সমাবেশে। আপ্রাণ বোঝাতে চাইলেন, দেশটাকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও তাঁর স্ত্রী সামান্থার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে। ছবি: রয়টার্স।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও তাঁর স্ত্রী সামান্থার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে। ছবি: রয়টার্স।

নিজস্ব সংবাদদাতা
লন্ডন শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৫৭
Share: Save:

তখন ছিল নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার। আজ লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। নরেন্দ্র মোদী ফের রক-তারকার ভূমিকায়। মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ালেন বিদেশে তাঁর সব চেয়ে বড় সমাবেশে। আপ্রাণ বোঝাতে চাইলেন, দেশটাকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মোদীর ঘোষণা মোতাবেক, বিদেশে থাকা ভারতীয়রা এখনই যে বদলটা টের পাচ্ছেন, তা হল ভারতকে কেউ আর এখন কৃপার চোখে দেখে না। সম্পর্কটা এখন সমানে সমানে। আর দেশে যে উন্নয়নের যজ্ঞ চলছে, তার ফল নজরে আসতে শুরু করবে খুব শীঘ্রই।

ওয়েম্বলির সমাবেশকে বিশ্বমঞ্চের এক মেগা-ইভেন্ট করে তোলার জন্য প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন ধরেই। কিন্তু জমাটি আয়োজন যখন প্রায় সারা, তখনই ভারতে পরের পর অসহিষ্ণুতার ঘটনা ও প্রতিবাদ কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল আয়োজকদের। কাল তো ব্রিটেনেই সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণ বিদ্ধ করেছে অসহিষ্ণুতা নিয়ে। বুদ্ধ-গাঁধীর শরণ নিয়ে কাল সে সব প্রশ্ন সামলেছেন মোদী। আর আজ ৬০ হাজার অনাবাসীর সামনে রকস্টারের মতো পারফরম্যান্সের জোরে মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইলেন তাঁকে ঘিরে যাবতীয় সমালোচনার। প্রথম দিনে অসহিষ্ণুতা প্রশ্নে যতই বিব্রত হোন, দ্বিতীয় দিনে মোদী ভারতের বহুত্ববাদকে ঢাল করেই কেড়ে নিতে চাইলেন অনাবাসীদের মনপ্রাণ। সমাবেশে হাজির প্রবাসীরাও কোমর বেঁধেই নেমেছিলেন গ্যালারিতে। মোদী-নামের জয়ধ্বনিতেই তাঁরা যেন উড়িয়ে দিতে চাইলেন মাঠের বাইরের সব সমালোচনা। বাস্তবে তা কত দূর সম্ভব, সে প্রশ্ন আলাদা। তবে, কী মঞ্চে, কী গ্যালারিতে— চেষ্টায় কোনও খামতি ছিল না।

এই প্রথম ওয়েম্বলিতে সভা করলেন কোনও রাষ্ট্রপ্রধান। আজ সারা দিন ধরেই ওয়েম্বলিমুখী ছিলেন ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তের অনাবাসীরা। বিশাল রঙ্গোলিতে এঁকে দেওয়া হয়েছিল ‘স্বাগত মোদী’ বার্তা। পঞ্জাব, মহারাষ্ট্রের ঢোলের তালে আগেই তৈরি হয়েছিল পরিবেশ। আলিশা চিনয় থেকে অনাবাসী শিল্পী জে শন-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভারত-ব্রিটেন মেলবন্ধনের বার্তা দেওয়া হয় বারবার। দু’দেশের সহযোগিতার চিহ্ন হিসেবে লন্ডনে আজ প্রধানমন্ত্রীর বাহন ছিল জাগুয়ার। যে গাড়ির নির্মাতা সংস্থা জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভারের মালিক এখন ভারতের টাটা গোষ্ঠী। ওই গাড়িতেই চড়ে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে পৌঁছলেন মোদী ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

মোদীর বক্তৃতার আগে অনুষ্ঠানের সুরটি বেঁধে দেন ক্যামেরন দম্পতি। সামান্থা মঞ্চে আসেন শাড়িতে, নিখাদ ভারতীয় সাজে। আর কামেরন জানিয়ে দেন, মোদী বলেছেন ‘অচ্ছে দিন আয়েগা’। মোদীর উৎসাহ দেখে মনে হয়েছে, ‘‘অচ্ছে দিন জরুর আয়েগা।’’

মোদী ব্রিটেনে এলেন ১২ বছর পরে। শুনেছিলে লন্ডনে বেশ ঠান্ডা পাবেন। কিন্তু হৃদয়ের উষ্ণতা ভরা অভ্যর্থনায় তাঁর ঠান্ডা লাগেনি। মোদী বলেন, ‘‘১২ বছরে টেমস দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ভারতের মানুষ আমার দায়িত্ব বদলে দিয়েছেন। চাওয়ালা এখন লালকেল্লা থেকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।’’

তাঁর জমানায় বহুত্ববাদের উপরে আক্রমণ নিয়ে বার বার আক্রমণের মুখে পড়ছেন মোদী। ওয়েম্বলিতে সেই বহুত্ববাদেরই জয়গান গাইলেন তিনি। সুফি-সহিষ্ণুতাও মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অহিংসার প্রসঙ্গ টেনে মোদী বলেন, বিশ্বের সব চেয়ে জ্বলন্ত দু’টি সমস্যা মেটানোর উপায় ভারতীয় সংস্কৃতিতেই আছে। সুফি ঐতিহ্য ইসলামে আরও প্রচার পেলে কেউ ধর্মের নামে বন্দুক হাতে তুলে নেবেন না। আর ‘দূরদর্শ়ী’ গাঁধীর অহিংসা ও বাণীতেই মুক্তির পথ মিলতে পারে সন্ত্রাস ও বিশ্ব-উষ্ণায়নের সঙ্কট থেকে।

মোদী জানাচ্ছেন, ব্রিটেনে ঘড়ি ঘুরছে উল্টো দিকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে গাঁধীর মূর্তি। ব্রিটিশ বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে বহিষ্কৃত ভারতীয় বিপ্লবী শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার নাম ১০০ বছর পরে ফের আসছে আইনজীবীদের তালিকায়।

কিন্তু কাজ এখনও অনেক বাকি আছে। তাই ভারতীয় রেলের উন্নতির জন্য লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে শুরু হয়েছে রেলের জন্য ভারতীয় টাকায় ‘রুপি’ বন্ডের ব্যবসা। সে কথা মনে করিয়ে দিয়েই কিছুটা হালকা সুরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যখনই আমরা রুপি বন্ড-এর কথা ভাবি, আমাদের জেমস বন্ড মনে পড়ে। আর একটু এগিয়ে আমরা ব্রুক বন্ডের কথা ভাবি। জেমস বন্ড আমাদের মনোরঞ্জন দেয় আর ব্রুক বন্ড দেয় সতেজতা। এখন উন্নয়নের জন্য চাই রুপি বন্ড।’’

উন্নয়নের খতিয়ান দিতে গিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মোদী নিজের সাফল্যগাঁধার ছত্রেছত্রে মিশিয়ে দিয়েছেন বিগত জমানার ব্যর্থতার কথা। প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনার কথা তুলে মনে করিয়েছেন, এত দিন দেশে কত মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই ছিল না। স্বাধীনতার ৭০ বছরেও ১৮ হাজার গ্রামে বিদ্যুত না পৌঁছনোর কথা তুলে জানতে চেয়েছেন, ওই কাজ ‘করনা চাহিয়ে কি নেহি চাহিয়ে’। এর সঙ্গে মনে করিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে তাই চাই বিকল্প শক্তির সন্ধান। সৌরশক্তির উপরে নির্ভরশীল রাষ্ট্রের সংগঠন গড়ে তাই এ কাজে নেতৃত্ব দিতে চায় ভারত। দুর্নীতি কমাতে দাওয়াই দিয়েছে তাঁর সরকার। তাই দুর্নীতি কমার হিসেবে চিনকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। আগামীর জন্য স্বপ্ন বোনার কাজটিও করেছেন নিজস্ব ঘরানায়। বলেছেন, ‘‘যে দেশের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বেশি তরুণ, সে দেশে দারিদ্র থাকার কারণ নেই।’’ তাতেই উচ্ছ্বাসে ফেটেছে ওয়েম্বলি।

গত কালের ব্যস্ত কর্মসূচি সামলানোর পরে ক্যামেরনের পল্লীভবন চেকার্সে তাঁর অতিথি হন মোদী। নানা বিষয়ে কথা হয় আলোচনার পাশাপাশি কিছুটা একান্ত মুহূর্তও কাটিয়েছেন তাঁরা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে রূপো, কাঠ ও মার্বেলের তৈরি বই রাখার দু’টি স্ট্যান্ড উপহার দিয়েছেন মোদী। দু’টিতেই খোদাই করা গীতার শ্লোক। উপহারের তালিকায় রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের উপরে বই, ক্যামেরনের স্ত্রী সামান্থার জন্য কেরলে তৈরি সুদৃশ্য আয়না, পশমিনা স্টোল।

পরের গন্তব্য ছিল বাকিংহাম প্রাসাদ। সেখানে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন মোদী। বাকিংহামের প্রবেশপথে মোদীকে স্বাগত জানান এলিজাবেথ। প্রধানমন্ত্রী ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান নন। তাই ব্রিটিশ রাষ্ট্রপ্রধান এলিজাবেথের সঙ্গে বিশেষ ঘোড়ার গাড়িতে লন্ডনে ঘোরা তাঁর ভ্রমণসূচিতে নেই। কিন্তু ভোজের আগে মোদীকে রাজকীয় সংগ্রহের কিছু জিনিস দেখান এলিজাবেথ। যেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের স্মৃতি। বারাণসীতে তৈরি কাঞ্চোই স্টোল, মকাইবাড়ির চা-র পাশাপাশি রানিকে কিছু ‘স্মৃতি’ উপহার দিয়েছেন মোদীও। যে স্মৃতি ধরা রয়েছে ১৯৬১ সা লে এলিজাবেথের প্রথম ভারত সফরের সময়ে তোলা কিছু ছবিতে।

কংগ্রেস অবশ্য বলছে, দেশের মাটিতে মোদীর ‘জাদু’ কমে আসছে বলেই বিদেশ নিয়ে এত মাতামাতি।

ওয়েম্বলিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টিভি-সংবাদপত্রে দেখা ভারত নরেন্দ্র মোদীর দেশ নয়। রাজস্থানের আলোয়ারে বসে মোবাইলের প্রচুর অ্যাপ তৈরি করে ফেলা ইমরান খানের দেশই তাঁর ভারত।

আর বিরোধীরা যা-ই বলুন, এ দিনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামও তাঁরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

narendra modi wembley visit to uk
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE