Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
আতঙ্কের দেশে আনন্দবাজার

স্তূপের নীচে বেঁচে আছে ছেলে, জানিয়েছে ফোনে

অহল্যার প্রতীক্ষা কি এর থেকেও তীব্র ছিল! গত দু’দিন ধরে নির্নিমেষে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। যদি ছেলে রাজীবের কোনও এসএমএস আসে। গত কালও তো এসেছিল। তা হলে আজ কেন আসবে না! অবুঝ দীনেশ বাবাহারে কোনও যুক্তি শুনতে নারাজ। সামনে ধ্বংসস্তূপের নীচে যে তাঁর ছেলে!

ভক্তপুরের বিধ্বস্ত গলি। মঙ্গলবার অনমিত্র সেনগুপ্তর তোলা ছবি।

ভক্তপুরের বিধ্বস্ত গলি। মঙ্গলবার অনমিত্র সেনগুপ্তর তোলা ছবি।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
ভক্তপুর (‌নেপাল) শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

অহল্যার প্রতীক্ষা কি এর থেকেও তীব্র ছিল!

গত দু’দিন ধরে নির্নিমেষে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। যদি ছেলে রাজীবের কোনও এসএমএস আসে। গত কালও তো এসেছিল। তা হলে আজ কেন আসবে না! অবুঝ দীনেশ বাবাহারে কোনও যুক্তি শুনতে নারাজ। সামনে ধ্বংসস্তূপের নীচে যে তাঁর ছেলে!

শনিবার দুপুরে তিনতলা বাড়ির নীচে আটকে পড়েছিলেন ভক্তপুরের বাসিন্দা দীনেশের ছেলে দশ বছরের রাজীব। শনিবারের ভূমিকম্প গোটা ভক্তপুরকে যে ভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাতে ঢিবি হয়ে যাওয়া বাড়ির তলায় কারও বেঁচে থাকার আশা প্রথমে ছেড়েই দিয়েছিলেন দীনেশ।

রবিবার দুপুরের পর থেকে মোবাইল পরিষেবা ফের শুরু হয়নেপালে। আর পাঁচ জনের মতো নেটওয়ার্ক আসে দীনেশের মোবাইলেও। আত্মীয়-পরিজনদের উত্কণ্ঠার এসএমএসের মধ্যে একটি এসএমএস পড়ে চমকে ওঠেন তিনি। এ তো ছেলে রাজীবের এসএমএস! আটকে পড়লেও বেঁচে আছে সে। লিখেছে, ভাল আছে। বাবা যেন তাঁকে এসে বাঁচায়।

এর পর থেকে জনে জনে ছুটে গিয়েছেন দীনেশ। নিজেও চেষ্টা করেছেন ধ্বংসস্তূপ সরানোর। কিন্তু সাধ্য কী তার এত বিশাল স্তূপ ফুঁড়ে তুলে আনেন সন্তানকে! ব্যর্থ হয়ে সেই ধ্বংসস্তূপের সামনেই দিনরাত্তির একাকার এখন দীনেশের। প্রথম এসএমএস পেয়েই ছেলেকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি তিনি তাকে বার করে আনবেন। কিন্তু কী ভাবে? কাজের কাজ কিছু হয়নি। কাল বিকেলেও শেষ বার একটি এসএমএস এসেছিল রাজীবের কাছ থেকে। পাল্টা উত্তরও দিয়েছিলেন তিনি। সেই শেষ। তার পর থেকে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি উভয় পক্ষের। আজ ফোন করার চেষ্টা করেছিলেন দীনেশ। কিন্তু তা লাগেনি। ধ্বংসাবশেষে নীচে আটকে পড়া রাজীবকে বাঁচাতে আসেনি কোনও উদ্ধারকারী বাহিনীও।

আসবেই বা কী করে! বোঝা গেল পথে নেমে। কাঠমান্ডু থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ভক্তপুর কার্যত এখন ধ্বংসপুরী। পনেরোশো শতকের মল্ল রাজাদের শহরের নাম ছিল ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকায়। শনিবারের পর সে সবই অতীত। সকালে ঝিরি-ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কাঠমান্ডু থেকে জনকপুরমুখী হাইওয়ে ধরেছিলাম ভক্তপুর যেতে। কাঠমান্ডুর শহর ছাড়াতেই পিচ ঢালা মসৃণ হাইওয়ে উধাও। যেন জানকীর ডাকে ধরণী দ্বিধা হয়ে রাস্তার বুক চিরে দিয়েছে। হাইওয়ে কোথাও বসে গিয়েছে কয়েক ফুট। কোথাও বা ধস নেমে যাতায়াত প্রায় বন্ধ।

তারই মধ্যে গাড়ি নিয়ে ভক্তপুরের মল্ল রাজার দরবারে যখন পৌঁছলাম আকাশ ভেঙে বৃষ্টি চলছে তখন। আশপাশের মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন দরবার এলাকার ফাঁকা চত্বরে। ত্রিপল খাটিয়ে কোনও ভাবে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই। ন্যায়টোপালা বা ভৈরবনাথের মন্দির মাটিতে মিশে গিয়েছে। চতুষ্কোণ চত্বরটি ঘিরে একটি বাড়িও অক্ষত নেই। যে মণ্ডপগুলি কোনও মতে টিকে রয়েছে, বৃষ্টি ও ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে সেগুলির দখল নিয়েছে অগুনতি কালো মাথা। সেখানে পৌঁছে জানা গেল, সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে দত্তাত্রেয় ও গোলমাটি এলাকায়। সেখানে এখনও আটকে রয়েছেন বহু মানুষ।

এগোনো গেল গোলমাটির দিকে।মল্ল রাজাদের রাজধানীকে ঘিরে আটশো বছর ধরে জনপদ গড়ে উঠেছে ভক্তপুরে। সরু গলি। কিছুটা হলেও কাশীর কথা মনে করিয়ে দেয়। কাশীর মতো এখানেও পর্যটনের রমরমা। সব বাড়ির নীচে দোকান। গলির দু’ধারে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশ বাড়িই চুন-সুরকির। আদ্যিকালের কড়ি-বরগা। জীর্ণ বাড়িগুলির শক্তি ছিল না শনিবারের প্রবল ভূমিকম্পের অভিঘাত সামলানোর। তাসের ঘরের মতো একের পর এক বাড়ি স্রেফ মাথা গুঁজে নীচে নেমে এসেছে। যাতায়াতের পথটুকুও নেই।

প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সেই ধ্বংসস্তূপ ও পিছল মাটি পেরিয়ে পৌঁছনো গেল গোলমাটির তিন নম্বর ওয়ার্ডে। ঢাল হয়ে নেমেছে গলিটি। ভূমিকম্পের কেন্দ্র এখান থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে হলেও তার তীব্রতা কত মারাত্মক ছিল, তা বোঝা যায় এই গলিতে এলে। ঢালের শুরু থেকে গলির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় একশো মিটার। গোটাটাই ধ্বংসস্তূপ। কোনও বাড়িকে আলাদা করে চেনা মুশকিল। বাড়িগুলি একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে মণ্ডে পরিণত হয়েছে। যেন বোমা-বিধ্বস্ত কতগুলি বাড়ির কাঠামো। এখানে-ওখানে কাদামাখা বই, চটি, সাইকেল, জীবনযাপনের খুঁটিনাটি আরও কত কী। জানান দিচ্ছে, ক’দিন আগেও ভরপুর প্রাণের স্পন্দন ছিল এখানে।

ভক্তপুর শহরে সব থেকে বেশি প্রাণহানি হয়েছে এই এলাকাতেই। এখানেই দেখা হয়েছিল দীনেশ বাবাহারার সঙ্গে। ছেলের জন্য ওই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই প্রাণ হাতে করে অপেক্ষা করে যাচ্ছেন তিনি। জনে জনে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘‘সাহায্য এল?’’ ৭২ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। যতসময় যাচ্ছে, কমে আসেছে আটকে পড়া মানুষগুলিকে বাঁচানোর আশা। দীনেশের আক্ষেপ, ‘‘এত ত্রাণ, এতসাহায্য আসছে শুনছি। কেন আমার ছেলেটাকে কেউ বাঁচাতে আসছে না?’’

ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে। ভক্তপুরে হাঁটতে হাঁটতে তিনটি জায়গা পেলাম যেখানে এখনও ধ্বংসস্তূপের তলায় আটকে রয়েছেন মানুষ। কিন্তু কোথাও তাঁদের উদ্ধারের জন্য কোনও সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। স্থানীয়রাই যতটা পারছেন করছেন। কিন্তু একটা সময়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিছু চিনা উদ্ধারকর্মী, রেড ক্রস ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য এগিয়ে এলেও নেই উপযুক্ত যন্ত্রপাতি বা যথাযথ প্রশিক্ষণ। পিছিয়ে যেতে হচ্ছে তাদেরও। সমস্যা যে রয়েছে তা স্বীকার করে নিয়ে ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের ডিজি ও পি সিংহ জানিয়েছেন, ‘‘ধ্বংসস্তূপ দ্রুত সরাতে বড় আকারের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির রাস্তা এত সরু যে বড় যন্ত্রপাতি যাচ্ছে না। ফলে হাত দিয়েই ধ্বংসস্তূপ সরাতে হচ্ছে। সময় লাগছে তাতে।’’

পরিস্থিতি যে তাদের নাগালের বাইরে, কার্যত তা স্বীকার করে নিচ্ছে নেপাল প্রশাসনও। খোদ প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা আজ সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন মৃতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়াতে পারে। কারণ এখনও বহু গ্রামের সঙ্গে য‌োগাযোগ করে ওঠা সম্ভব হয়নি। পুরো ছবিটা সামনে এলে মৃতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়াতে পারে। ছাপিয়ে যেতে পারে ১৯৩৪-র স্মৃতিকেও। সে বার ভূমিকম্পে সাড়ে আট হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন নেপালে। এই অবস্থায় বিদেশি রাষ্ট্রগুলির কাছে আরও উদ্ধারকারী দল, চিকিৎসক ও ত্রাণ চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন কৈরালা। যদিও ত্রাণ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিমানের ভিড় কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। কিন্তু কর্মীর অভাবে ত্রাণ নামাতে প্রচুর সময় লেগে যাচ্ছে। জায়গার অভাবে বাধ্য হয়ে ফিরেও যেতে হচ্ছে বেশ কিছু বিমানকে। রাজধানী কাঠমান্ডুতে এ দিনও দোকান-পাট ছিল বন্ধ। শহরের মানুষ মাঠেই তাঁবু ফেলে রয়েছেন। এ দিন সন্ধের পর থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও টেলিফোন লাইন ঠিক হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, তাঁরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছেন। কিন্তু এ আশ্বাস তিলমাত্র সান্ত্বনা দিতে পারছে না দীনেশকে। ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে ছেলের ফোন এসেছিল কিনা জানতে চেয়ে রাতে যোগাযোগ করে নিরাশই হতে হল।

তবে বাবার মন আশা ছাড়তে নারাজ। দীনেশ বলে চলেন, ‘‘হয়তো মোবাইলের টাওয়ার নেই। কিংবা চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছে। হয়তো ছেলেটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ও বেঁচে ঠিকই আছে।’’ কথা বাড়াইনি আর। ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। দীনেশের কথাগুলি বিশ্বাস করতে কার না মন চাইবে! প্রশ্নটা তবু তাড়া করে চলেছে, বছর দশেকের ছেলেটার কাছে উদ্ধারকারীরা পৌঁছবে তো সময়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE