কওসর ওরফে মিজান
বর্ধমানের খাগড়াগড় থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার। জেহাদি-চক্রের গোপন গবেষণাগার থেকে প্রধানমন্ত্রীর যাত্রাপথ। সন্ত্রাসী বিস্ফোরণের সূত্রধর সেই এক জনই! কওসর ওরফে মহম্মদ জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান!
অন্তত বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের দাবি তেমনই। এ দেশের গোয়েন্দারাও মনে করেন, খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের সূত্রে যে জেহাদি জঙ্গি-চক্রেরহদিস মিলেছে, তাকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা রহস্যের আসল চাবিকাঠিরয়েছে কওসরেরই হাতে। যদিও খাগড়াগড়-কাণ্ডের পাঁচ মাস বাদেও সন্দেহভাজন সেই বাংলাদেশিরনাগাল পাওয়া যায়নি। এ বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারকনভয়ের রুটে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের নেপথ্যে তারই ছায়া দেখছেন সে দেশের গোয়েন্দারা।
গত শনিবার শেখ হাসিনা ঢাকার সুরাবর্দি উদ্যানে আওয়ামি লিগের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে পর পর কয়েকটি বিস্ফোরণ হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র খবর, ঘটনার পরে সে দিনই বাংলাদেশের গোয়েন্দারা কওসর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে আইবি’কে অনুরোধ জানান। দিল্লি অনুরোধ রেখেছে। আইবি জানিয়েছে, খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের দিনে, অর্থাৎ গত ২ অক্টোবর বিকেলে বীরভূম জেলার নানুর-বোলপুরের কিছু অঞ্চলে কওসরকে শেষ বার দেখা গিয়েছিল।
সেই শেষ বার। ভারতীয় ভূখণ্ডে কওসরের অস্তিত্ব আর গোয়েন্দা-নজরে ধরা পড়েনি। আইবি-র অনুমান, মুর্শিদাবাদের লালগোলা সীমান্ত টপকে কওসর বাংলাদেশের রাজশাহি জেলায় ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে ঢাকায়।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে আইবি এ-ও জেনেছে, খাগড়াগড়ে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর কারখানা তথা গবেষণাগারে যে ধরনের আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পাওয়া গিয়েছিল, শনিবার ঢাকার কারওয়ান বাজারের কাছে একই ধরনের আইইডি ফেটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আইবি’র সন্দেহ, জেএমবি-র লোকজন সেগুলো পশ্চিমবঙ্গে বসেই বানিয়ে থাকতে পারে। পরে হয়তো বাংলাদেশে পাচার করেছে। এই অনুমানের ভিত্তিতে ভারতীয় গোয়েন্দারা খোঁজ-খবর শুরু করেছেন।
প্রসঙ্গত, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) জানতে পেরেছে, বর্ধমানের খাগড়াগড়ের আগে জেএমবি-জঙ্গিরা বিস্ফোরকের কারখানা ফেঁদেছিল মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায়। এনআইএ-র দাবি: ২০০৭-এর শেষাশেষি বেলডাঙার ডেরায় আইইডি, দেশি গ্রেনেড ইত্যাদি বানানো শুরু হয়। পরে কারখানা সরিয়ে আনা হয় খাগড়াগড়ে। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, অক্টোবরের বিস্ফোরণে সব কিছু ফাঁস হওয়ার আগে পর্যন্ত দুই ডেরা মিলিয়ে জেএমবি হাজার দুয়েক বোমা বানিয়েছিল।
ঘটনা হল, খাগড়াগড়ের কারখানায় ৫৫টি ও বর্ধমানের বাদশাহী রোডের ঘাঁটিতে ৩৮টি--- মোট শ’খানেকের বেশি বোমা উদ্ধার করা যায়নি। তদন্তকারীদের অনুমান, তার আগেই অধিকাংশ বিস্ফোরক সীমান্ত টপকে বাংলাদেশে চলে গিয়েছে।
জেএমবি’র সন্ত্রাস-চক্রে মিজান ওরফে কওসরের ভূমিকা কী?
এনআইএ-তদন্তের গোড়াতেই জানা যায়, জেএমবি’র কারখানায় তৈরি বোমার মুখ্য ‘ক্যুরিয়র’ ছিল কওসর। মূলত তারই হাত দিয়ে বোমার চালান বিবিধ ‘ঠিকানা’য় পৌঁছাত। “এমনকী, সেই ২ অক্টোবরেও বেশ কিছু আইইডি খাগড়াগড়ের কারখানা থেকে কওসর মারফত পাচারের পরিকল্পনা চক্রীরা করেছিল।” জানাচ্ছেন এক গোয়েন্দা-কর্তা। সন্ত্রাস-যজ্ঞের এ হেন হোতাকে হাতে পেতে এনআইএ স্বভাবতই মরিয়া। কওসরের মাথার দাম তারা ধার্য করেছে দশ লাখ টাকা। ‘বোমারু’র খোঁজে ঢাকাও হন্যে। বস্তুত জঙ্গি-তদন্তের তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে দু’পক্ষই নিবিড় যোগাযোগ রেখে চলছে। খাগড়াগড় কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে এনআইএ-র দল ঢাকায় গিয়েছিল। পরে বাংলাদেশি গোয়েন্দারা কলকাতায় এসে এনআইএ-র সঙ্গে কথা বলেন। এ যাবৎ এনআইএ-র ‘ওয়ান্টেড লিস্ট’-এ কওসরের যে ছবিটি ছিল, সেটি প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে আঁকানো সাদা-কালো স্কেচ। সম্প্রতি তার জায়গায় এসেছে পুরোদস্তুর রঙিন ফোটোগ্রাফ, যা কিনা বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছে বলে এনআইএ সূত্রের খবর।
আইবি-সূত্রে জানা গিয়েছে, কওসর ছাড়া খাগড়াগড়-কাণ্ডে আরও যে সব বাংলাদেশির দিকে সন্দেহের তির, শনিবারের ঘটনার পরে ঢাকার গোয়েন্দারা তাদের তালিকা দিল্লির কাছে আবার চেয়েছেন। সন্দেহভাজন-তালিকায় মুখ্য চারটি নাম হল: হাতকাটা নাসিরুল্লা ওরফে সুহেল, তালহা শেখ, সালাউদ্দিন শেখ ওরফে হাফিজুর ওরফে মহিন ও রফিক। প্রত্যেকেই ফেরার। হাতকাটা নাসিরুল্লা ও তালহার মাথার দাম ধরা হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা করে। সালাউদ্দিনের জন্য পাঁচ লাখ। রফিকের খোঁজ দিলে এনআইএ ইনাম দেবে এক লাখ টাকা।
এবং কারওয়ান বাজার বিস্ফোরণের তদন্তে কওসরের পাশাপাশি এদের নামও উঠে আসছে। “আমরা জানতে পেরেছি, ঢাকায় শনিবারের ধারাবাহিক বিস্ফোরণে কওসর তো বটেই, হাতকাটা নাসিরুল্লা ও তালহা শেখের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।” বলছেন এক আইবি-কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy