উধাও বিমানের খোঁজে আকাশ ও জলপথে তল্লাশি। রবিবার। ছবি: এএফপি।
দিনের আলো ফুটতে না-ফুটতেই তোলপাড় শুরু হয়েছিল তাইল্যান্ড উপসাগরে। কিন্তু খোঁজ মিলল না মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর বিমানটির। শুধু ভিয়েতনাম জানিয়েছে, সমুদ্রগর্ভে তাঁরা একটা যন্ত্রাংশ খুঁজে পেয়েছেন, যেটা নিখোঁজ বিমানের একটি দরজা হলেও হতে পারে। এখন নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য আর পাসপোর্ট-চুরির ঘটনা সামনে আসার পর থেকে নাশকতার সম্ভাবনাই ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে।
শনিবার গভীর রাতেই ইতালি এবং অস্ট্রিয়ার বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছিল, তাদের দেশের যে দুই বাসিন্দার নাম ওই বিমানের যাত্রী-তালিকায় রয়েছে, তাঁরা বিমানটিতে ছিলেন না। দু’দেশের বিদেশ মন্ত্রকই দাবি করে, গত দু’বছরে তাইল্যান্ড থেকে ওই দুই বাসিন্দারই পাসপোর্ট চুরি গিয়েছে। সে দাবি যে সত্যি, তা রবিবার ইন্টারপোলও জানিয়েছে। কিন্তু বিমানটির যাত্রী-তালিকা দেখাচ্ছে, শুক্রবার গভীর রাতের বেজিংগামী এমএইচ ৩৭০ উড়ানটিতে চড়েছিলেন ইতালীর লুইজি মারাল্ডি এবং অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টিয়ান কোজেল। সুতরাং মনে করা হচ্ছে যে, লুইজি এবং ক্রিস্টিয়ানের পাসপোর্ট হাতিয়ে বিমানে উঠেছিলেন অন্য কেউ।
এবং এখান থেকেই দানা বাঁধছে নাশকতার সম্ভাবনা। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, একই পর্যটন সংস্থা থেকে লুইজি এবং ক্রিস্টিয়ানের নাম করে পরপর দু’টি টিকিট কেটেছিলেন দু’জন। পর্যটন সংস্থার দেওয়া তথ্য থেকেই পরিষ্কার, দু’জনের টিকিটেরই পরপর নম্বর ছিল। এবং দু’জনেই তাইল্যান্ড থেকে টিকিট কেটেছিলেন। তাইল্যান্ড থেকেই আসল লুইজি এবং ক্রিস্টিয়ানের পাসপোর্টও চুরি গিয়েছিল। সেই চুরি শুধুই বিমানের টিকিট পেতে নাকি নাশকতার চক্রান্ত করতে, তা নিয়ে এখনও কিছু বলতে পারছে না মালয়েশিয়া সরকার। বেআইনি অভিবাসনও একটা উদ্দেশ্য হতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে। তবে নাশকতার সম্ভাবনাকেও যে তাঁরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখছেন, সে কথা এ দিন নিজেই জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার পরিবহণমন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেন। একই সঙ্গে উস্কে দিয়েছেন অন্য বিভ্রান্তিও।
রবিবার অনুসন্ধান অভিযান যখন পুরোদমে চলছে, ঠিক তখনই পাসপোর্ট-চুরি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে হিশামুদ্দিন বলেন, “চার জনের নাম আমার কাছে আছে। দেশের গোয়েন্দা দফতরকে এ বিষয়ে জানিয়েছি এবং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি।” স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তবে কি ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে সফরকারী দুই ব্যক্তি ছাড়া আরও দুই সন্দেহভাজন ছিলেন? হিশামুদ্দিন কিন্তু তাঁদের পরিচয় জানাননি। পরে আবার বিমান দফতরের প্রধান আজহারউদ্দিন আব্দুল রহমান জানান, দু’জন যাত্রীকে নিয়েই তদন্ত চলছে। কর্তৃপক্ষ তাঁদের গতিবিধির সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছেন।
মালয়েশিয়ার বিমানবাহিনীর প্রধান রোডজালি ডউড় আরও একটি তথ্য দিয়েছেন। জানিয়েছেন, “রেডারের পুরনো রেকর্ডিং ঘেঁটে দেখেছি আমরা। এবং আমাদের মনে হচ্ছে, বিমানটি হয়তো কুয়ালা লামপুরে ফেরার চেষ্টা করেছিল।” কিন্তু তা হলে রীতি মেনে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলকে কোনও বিপদ সঙ্কেত পাঠালেন না কেন বিমানচালক? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পিছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। এক, বিমানের ইঞ্জিন বা অন্য কোনও যন্ত্র হয়তো গড়বড় করছিল। ফলে সেটা সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কর্মীরা। অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, যাতে কোনও বিপদ সঙ্কেতই পাঠাতে না-পারেন চালক। সুতরাং ঘুরেফিরে নাশকতার সন্দেহই বাড়ছে।
তবে রয়ে যাচ্ছে আরও কিছু প্রশ্ন। প্রথমত, যদি জঙ্গিরাই বিমান ছিনতাই করে থাকে, সে ক্ষেত্রে নিজেদের দাবি আদায় করার জন্য এটিসির সঙ্গে লাগাতার যোগাযোগ করে যাওয়ার কথা তাদের। আর যদি স্রেফ নাশকতার জন্যই বিমান ছিনতাই করে থাকে কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী, তা হলে বিমান ধ্বংস করে দেওয়ার পরে সেটা সাধারণত তারা জানিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে কিছুই হয়নি।
তা হলে কি দুর্ঘটনা? সে সম্ভাবনাও কম। কারণ, ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায় যখন বিমানটি উড়ছিল, তখনও সুবাঙ্গের এটিসিকে কিছু জানায়নি সে। শুক্রবার রাতে আবহাওয়া খারাপ ছিল না। তবে অন্য একটি একটি বোয়িং ৭৭৭-এর চালক দাবি করছেন, শুক্রবার রাত দেড়টার (মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স জানিয়েছে সে সময়ই শেষ বারের মতো এটিসির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল এমএইচ ৩৭০-র) কিছু পরেই হারিয়ে যাওয়া বিমানটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন তাঁরা। তখনই কো-পাইলটের সঙ্গে খুব অপরিষ্কার কথাবার্তা হয় তাঁর। সেই শেষ। আর যোগাযোগ করা যায়নি।
কিন্তু বিমানটা গেল কোথায়? যদি মাঝ-আকাশেও ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলেও তার চিহ্ন পাওয়া যাওয়ার কথা। যাত্রীদের দেহাংশ মেলার কথা কোথাও না কোথাও। সে সব খুঁজে বার করার উপরেই মনোনিবেশ করেছে মালয়েশিয়া। ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, চিন, সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ড-আমেরিকা সকলেই পাশে দাঁড়িয়েছে।
এ দিন প্রায় ৪০টিরও বেশি বিমান আর দু’ডজনেরও বেশি জাহাজ অনুসন্ধান চালায়। তাইল্যান্ড উপসাগরের যেখানে তেল ভাসতে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই বিমানের ধ্বংসাবশেষের মতো কিছু একটা ভাসতে দেখা যায়। ভিয়েতনামের উদ্ধারকারী নৌকো পরে সেটি খতিয়ে দেখে। ভিয়েতনাম সেনার ডেপুটি চিফ অব স্টাফ থান নিয়েন জানিয়েছেন, থো চু দ্বীপ থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাওয়া ওই বস্তুটি নিখোঁজ বিমানের একটি দরজা হতে পারে। তবে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে ওই সূত্র ধরে এগিয়েই বিমানের বাকি অংশও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
অগত্যা অপেক্ষাই ভরসা। এ দিনও বেজিংয়ের বিমানবন্দরে হতাশ মুখে অপেক্ষা করতে দেখা গিয়েছে সস্ত্রীক সংবেদ কোলেকরকে। তাঁর গোটা পরিবার ওই বিমানেই ছিল। সমাজকর্মী চন্দ্রিকা শর্মার পরিবারও প্রাণপণে চাইছে, একটা অলৌকিক কিছু ঘটুক। বাকিদের অবস্থাও করুণ। সময় যত গড়াচ্ছে, খারাপ পরিণতির সম্ভাবনাই বাড়ছে। সে দিক মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সাহায্য চেয়েছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স।
ধোঁয়াশা যেখানে
• ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে ঠিক ক’জন বিমানে উঠেছিল?
• ভুয়ো পাসপোর্টের যে দুই যাত্রীর কথা আগেই জানা গিয়েছিল,
তারা একই সঙ্গে একই জায়গার টিকিট কেন কেটেছিল?
• উদ্দেশ্য নাশকতা না বেআইনি অভিবাসন?
• হঠাৎ কেন কুয়ালা লামপুর ফেরার চেষ্টা করেছিল বিমানটি?
• এটিসি-কে কেন বিপদ সঙ্কেত পাঠাননি বিমানচালক?
• নাশকতা উদ্দেশ্য হলে কোনও দাবি পেশ করা হল না কেন?
• সমুদ্রে যে তেল ভাসছে, তা কীসের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy