Sheikh Hasina Verdict

নিজের ফাঁসির নির্দেশ শোনা তো সহজ নয়! তবে কঠিন কিছু হবে জানতাম! আসাদুজ্জামান বলে দিলেন আনন্দবাজার ডট কম-কে

ঢাকা থেকে তাঁর অবস্থান এখন মোটামুটি ৩০৬ কিলোমিটার দূরে। এই দূরত্ব কি আর কোনও দিন ঘুচবে? আর যদি ঘুচেও যায়, তা হলে কি প্রাণটা বাঁচবে? হাসিনা জমানার শেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘‘আমি মুক্তিযুদ্ধে লড়েছি। প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়েছি।’’ তারপরে বললেন নিজের পরিকল্পনার কথা।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:১৮
Share:

(বাঁ দিকে) শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

মাস দেড়েক পরেই তাঁর জন্মদিন। নিখুঁত হিসাব কষে বললে ঠিক ৪৪ দিন পরে ৭৫ বছর পূর্ণ করবেন। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই তিনি নিজের ফাঁসির আদেশ শুনেছেন। তাঁর নিজের দেশের এক আদালত (যাঁকে তাঁরা ‘প্রহসন’ বলছেন) তাঁকে ‘গণহত্যা’র দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। করে ফাঁসির শাস্তি দিয়েছে। সোমবার দুপুরে বাংলাদেশের আদালত ঘোষণা করেছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁরও ফাঁসি হবে।

Advertisement

তিনি আসাদুজ্জামান খান কামাল। বাংলাদেশে হাসিনা জমানার শেষ প্রায় এক দশক ধরে তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে। ছিলেন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা। নিজের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা শোনার ঘণ্টা তিনেক পরে যিনি আনন্দবাজার ডট কম-কে ফোনে বললেন, ‘‘মরতে ভয় পাই না!’’

২০২৪ সালের ৫ অগস্ট বাংলাদেশে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে’ হাসিনার পতনের পর থেকে হাসিনা নিজে যেমন দেশছাড়া, তেমনই দেশছাড়া তাঁর সরকারের ও দলের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। আসাদুজ্জামান তাঁদের অন্যতম। হাসিনা সেই থেকে দিল্লিতে রয়েছেন, সে কথা এখন গোটা বিশ্ব জানে। বাকিদেরও অধিকাংশই যে ভারতেই রয়েছেন, তা আবার অনেকে জেনেও জানেন না। আসাদুজ্জামানের অবস্থানও অনেকটা তেমনই। কলকাতায় রয়েছেন। পরিচিত বা বিশ্বস্ত বৃত্তের কাছে সে কথা গোপন করছেন না। তবে কোথায় থাকছেন, কী করছেন ইদানীং, সে বিষয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিচ্ছেন না।

Advertisement

সোমবার দুপুরে আরও অনেকের মতো আসাদুজ্জামানও উৎকণ্ঠা নিয়ে টেলিভিশনে নজর রেখে বসেছিলেন। বাংলাদেশের ট্রাইবুনাল কী রায় ঘোষণা করছে, তার সরাসরি সম্প্রচার দেখছিলেন। কলকাতার যে অংশে তিনি বছরখানেক ধরে রয়েছেন, সে এলাকা ঈষৎ জনবিরল। ঘিঞ্জি মহানগর পরিসরের বাইরে। তার উপরে থাকেনও প্রায় একাই। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন যেমন লোকলস্কর, সিপাইসান্ত্রী নিয়ে দিনভর ওঠাবসা ছিল, ঠিক তার বিপরীত মেরুতে এখন তাঁর বাস। সেই আপাত একাকিত্বের মধ্যে বসেই শুনলেন বিচারপতির উচ্চারণ— ‘আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে’।

শুনে ক্ষণিকের জন্য কি বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল মেরুদণ্ড বেয়ে? নিজের কানে নিজের ফাঁসির আদেশ-শোনা আসাদুজ্জামান আনন্দবাজার ডট কম-কে বললেন, ‘‘আমরা জানতাম এই রকম রায়ই হবে। গত এক বছরে বাংলাদেশে ঘটনাপ্রবাহ যে পথে এগিয়েছে, যে ভাবে সব কিছু সাজানো হচ্ছিল, তাতে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম যে, এই রায়ই ঘোষিত হতে চলেছে। তাই চমকে যাইনি।’’

চমকে হয়তো যাননি। হয়তো মানসিক প্রস্তুতি ছিলই। তবু টেলিভিশনের সামনে বসে নিজের ফাঁসির আদেশ শোনা কি সহজ? কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্য আর স্বাভাবিকতা ধরে রেখে কথা বলার চেষ্টা এই প্রশ্নের পরে ভেস্তে গেল। ফোনের ও পার থেকে স্বল্পমেয়াদি হাসির শব্দ। তার পরে বললেন, ‘‘ঠিকই বলেছেন। নিজের ফাঁসির নির্দেশ শোনা সহজ তো নয়ই। সহজ মনেও হয়নি। তবে কঠিন কিছুই হবে, সে কথা তো জানতামই।’’

ঢাকা থেকে তাঁর অবস্থান এখন মোটামুটি ৩০৬ কিলোমিটার দূরে। এই দূরত্ব কি আর কোনও দিন ঘুচবে? আর যদি ঘুচেও যায়, তা হলে কি প্রাণটা বাঁচবে? হাসিনা জমানার শেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘‘আমি মুক্তিযুদ্ধে লড়েছি। প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়েছি। এই মানসিকতা নিয়েই লড়েছিলাম যে, হয় মারব, না হয় মরব। তাই মরতে ভয় পাই না। এখনও পাই না।’’

তরুণ বয়সে যে মুক্তিযুদ্ধ লড়েছিলেন, এখন কি সে যুদ্ধ আরও একবার লড়ার ভাবনা বাস্তব? না সেই পরিস্থিতি রয়েছে, না রয়েছে আসাদুজ্জামানের সেই বয়স। বাংলাদেশের প্রাক্তন অথবা দেশছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘‘আওয়ামী লীগকে আগেও একাধিক বার এ বাবেই আঘাত করা হয়েছে। নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে। বার বার আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। দিন ঘুরবেই। আমাদের ভাবনাকে অবাস্তব ভাববেন না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ভাল করে খেয়াল করুন। সব কিছুই আগের বারের চেষ্টাগুলোর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। প্রতি বারই আমাদের উপরে আঘাতগুলো এসেছিল পাকিস্তানের মদতে। এ বারও তাই পাকিস্তানের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষিটা দেখতেই তো পাচ্ছেন সবাই। সুতরাং চিন্তা করবেন না।’’

হাসিনার পতনের জেরে যাঁরা বাংলাদেশছাড়া, তাঁদের মধ্যে একা আসাদুজ্জামান কলকাতায় রয়েছেন, এমন নয়। সে জমানার আরও এক ঝাঁক মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা এমনকি কূটনীতিকও কলকাতায় রয়েছেন। সকলেই আসাদুজ্জামানের মতো প্রায় অজ্ঞাতবাসে। সকলেই এ দেশে নিজেদের খুব পরিচিত এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একটি বৃত্তের সঙ্গে সন্তর্পণে যোগাযোগ রাখছেন। তার বাইরের আর কারও সঙ্গে দেখা করা বা ফোন ধরা এড়িয়ে চলছেন। কেউ শহরের প্রাণকেন্দ্রে, কেউ কোনও উপনগরীতে, কেউ শহরতলির দিকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে খাতে বয়ে চলেছে, তাতে কারওরই উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ কমার অবকাশ নেই। সোমবার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের দেওয়া রায় সেই মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে অনেকে সে চাপ হালকা করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা আসাদুজ্জামানও বলেছেন। কিন্তু চাপ হালকা করতে পেরেছেন কি? কলকাতায় নিজের দেশের আরও অনেকের মাঝেই তিনি রয়েছেন ঠিকই। কিন্তু সোমবার তো সবার মধ্যে তিনি একদম একা। এ শহরে আশ্রয় নেওয়া আর কারওর ফাঁসির নির্দেশ তো হয়নি।

বলিষ্ঠ মুখমণ্ডল। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ফোনে কথা বলার সময়ে কণ্ঠের সে বলশালী ভাব ধরে রাখার চেষ্টাও নিরন্তর চালাচ্ছেন। কিন্তু অলক্ষেই কপালের বলিরেখাগুলো গভীর হয়ে উঠছে কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement