Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Bengal Classical Music Festival

শেষ হল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব, ৫ দিনের প্রাপ্তি ৩৬০ দিনের বড় সঞ্চয়

টানা এক মিনিট করতালির পর শুরু হল ললিত রাগের বাদন। দু’চোখ বন্ধ চৌরাসিয়ার। পিনপতন স্তব্ধতায় পরিপূর্ণ ধানমন্ডি আবাহনী মাঠ। সময় স্থির।

শেষ দিনে বাঁশি পরিবেশন করলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

শেষ দিনে বাঁশি পরিবেশন করলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

অঞ্জন রায়
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:১৯
Share: Save:

শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের শেষ দিনের আয়োজন। এ দিন ছিল উপস্থিতির হিসাবে ঢাকায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আসরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। প্রায় শুরু থেকেই প্যান্ডেল, মাঠ, শান বাঁধানো ফুটবলের দর্শক গ্যালারি মানুষের ভিড়ে টইটুম্বুর। সবার অপেক্ষা কখন বাঁশি হাতে তুলে নেবেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া। অপেক্ষা পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্টের মোহন বীণা, ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের খেয়াল, পণ্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণজিত দাসের সেতার এবং পণ্ডিত কৈবল্যকুমারের খেয়াল শোনার।

শেষ দিনের অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র ওড়িশি নৃত্য পরিবেশন করেন। সঙ্গে ছিলেন সৌম্য বসু। অর্ধনারীশ্বর ও রামায়ণ লং দুই পর্বে পরিবেশনাটির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের কোরিওগ্রাফ এবং নৃত্যের রচয়িতা প্রয়াত পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র, সঙ্গীতে পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্রে। দ্বিতীয় অংশের সংগীত পণ্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্রের।

এরপরে শুরু বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের সমাপনী অধিবেশন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফজলে হাসান আবেদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সনজীদা খাতুন, ফরিদুর রেজা সাগর এবং আমিনা আহমেদ।

আরও পড়ুন: উদ্বোধন হল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের

আরও পড়ুন: সুরে ডুবে ঢাকা, তৃতীয় রাত শেষ হল অজয় চক্রবর্তীর ভৈরবীতে

সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া উচ্চাঙ্গ সংগীতের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারে কাজ করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় প্রতি বছর এই উৎসব নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটাও গর্বের ব্যাপার। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারলে আরও ভাল লাগবে।”

সমাপনী অধিবেশনে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বললেন, “আমি শুধু পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। কিন্তু এই উৎসব আয়োজনের সব পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা না থাকলে আমরা এই উৎসব আয়োজন করতে পারতাম না।”

ভোরের কিছু পরে শেষ হল এ বারের উৎসব।

রাত ১০টায় শুরু হল পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ খেতাবপ্রাপ্ত পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্টের মোহনবীণার পরিবেশনা। মোহনবীণা শব্দযন্ত্রটি বাংলাদেশে খুব প্রচলিত নয়। এই শব্দযন্ত্রটি তৈরিই করেছেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। ২০ তারের হাওয়াই গিটারের বদল ঘটে হয়েছে এই মোহনবীণা। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন শৌভেন চট্টোপাধ্যায়। রাগ মরু বেহাগ ও ধুন পরিবেশন করেন তাঁরা।

রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে মঞ্চে এলেন বিষ্ণুপুর ঘরানায় খেয়াল শিল্পী ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়। শোনালেন রাগ যোগ। খেয়াল শেষেই মাঠজুড়ে সেতারের ইন্দ্রজাল- মঞ্চে সেনিয়া মাইহার ঘরানার দুই সেতার পণ্ডিত কুশল দাস ও তাঁর ছেলে কল্যাণজিৎ দাস। রাত বেড়েই চলেছে, সঙ্গে সেতারে যোগ কোষের যুগলবন্দি। এরপর তিনি একটি ঠুমরীও শোনালেন। তবলায় ছিলেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হারমোনিয়ামে গৌরব চট্টোপাধ্যায়, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী এসএম আশিক আলভি এবং অপূর্ব কর্মকার।

মধ্যরাত শেষে খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত কৈবল্য কুমার। রাগ গোরখ কল্যাণ ও খাম্বাজে ঠুমরীও শোনালেন তিনি। সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন শ্রীধর মন্দ্রে, হারমোনিয়ামে সুধাংশু কুলকার্নি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল কুমার মালাকার ও অভিজিৎ দাশ।

এভাবেই ঘড়ির কাঁটা যখন ভোর ৪টে ছুঁয়েছে তখনই এলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। পুরো সমাবেশ তখন দাঁড়িয়ে করতালিতে স্বাগত জানালো এই কিংবদন্তিকে। তিনি প্রণাম জানিয়ে বললেন, “প্রতিবারই বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের সমাপ্তির সময়ে আমি থাকতে পেরেছি। আমি আবারও আসতে চাই। আপনাদের শোনাতে চাই বাঁশি।”

টানা এক মিনিট করতালির পর শুরু হল ললিত রাগের বাদন। দু’চোখ বন্ধ চৌরাসিয়ার। পিনপতন স্তব্ধতায় পরিপূর্ণ ধানমন্ডি আবাহনী মাঠ। সময় স্থির। সব কিছু হারিয়ে গিয়ে তখন শুধু সুর। রাতজাগা নাগরিক পাখিরাও ডাকছে না। শেষ হল ললিত। এবারে জনপ্রিয় লোকসুরের যাদু। চেনা সুর এত শুদ্ধ, এত পূর্ণ হতে পারে সেটা এই ভোরের আগে অজানা ছিল সবার।

পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াকে বাঁশিতে সঙ্গত করেছেন বিবেক সোনার ও ইউকা নাগাই, তবলায় ছিলেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, পাখোয়াজে পণ্ডিত ভবানী শঙ্কর এবং তানপুরাতে মুশফিকুর ইসলাম।

ভোর ৫ টার কিছু পরে পর্দা নামলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের ষষ্ঠ আসরের। পূর্ণ মাঠ ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছ। কারও মুখেই রাত জেগে থাকার ক্লান্তি নেই। আছে সুরের অমৃত ধারাতে ঢুবে থাকার প্রশান্তি। ৫ দিনের যে প্রাপ্তি, সেই প্রাপ্তি আগামী ৩৬০ দিনের অনেক বড় সঞ্চয় প্রতিটি দর্শকের কাছে। সেই সঞ্চয় নিয়েই অসুন্দর আর অসুরের কাছে থেকে দূরে থাকার স্বপ্নটা বেঁচে থাকুক- আগামী উৎসব পর্যন্ত এমন ভাবনা প্রত্যেক দর্শকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE